বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

যুগান্তকারী রায়ে সাত জঙ্গির ফাঁসি

আরাফাত মুন্না ও তুহিন হাওলাদার

তিন বছর আগে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় ২২ জনকে হত্যার দায়ে নব্য জেএমবির সাত সদস্যের ফাঁসির দন্ড দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ না হওয়ায় এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সব আসামিকে। প্রত্যেককে ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও দিয়েছে আদালত, যা অনাদায়ে আরও কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। বিচার শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় গতকাল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান জনাকীর্ণ আদালতে আলোচিত এ মামলার যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন।

বিচারক রায়ে বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয় রায়ে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় সাত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক রায়ে বলেন, এতে ভাগ্যহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন। ফাঁসির দন্ড পাওয়া সাত আসামি হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আবদুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। আর খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। রায় ঘোষণার সময় সব আসামিই এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। রায় শুনে তাদের কারও চেহারাতেই অনুশোচনার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। বরং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সঙ্গে আদালতে হট্টগোলও করেন জঙ্গিরা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা স্তম্ভিত করেছিল পুরো বাংলাদেশকে। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ হামলা মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত এক বছরে রাষ্ট্রপক্ষ এই হামলা মামলায় ১১৩ জন সাক্ষী হাজির করেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন নিহত পুলিশ সদস্যদের স্বজন, হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে আহত পুলিশ, হোলি আর্টিজান বেকারির মালিক ও কর্মী, জিম্মি হয়ে পড়া অতিথি এবং যেসব বাড়িতে আস্তানা গেড়ে নৃশংস এই হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, সেসব বাড়ির মালিকেরা। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয় ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশ এলাকায়। রায়ের দিন আদালতে আসা বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিরাপত্তা-তল্লাশির। প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি হাতে থাকা ব্যাগও তল্লাশি করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বন্ধ রাখা হয়েছিল আদালত এলাকার দোকানপাটও।

দোষী সাব্যস্ত হওয়া আসামির কার কেমন সাজা : হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় দায়ের হওয়া মামলার আট আসামির মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন ধরনের সাজা দিয়েছে আদালত। আর এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আবদুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬ (২)(অ) ধারায় মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই আসামিকে আইনের ৭ ধারায় মামুনুর রশিদ রিপন বাদে সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড, ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮ ধারায় সব আসামিকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ড এবং ৯ ধারায় পাঁচ বছরের কারাদন্ডের সঙ্গে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১০, ১১, ১২, ১৩ ধারার অভিযোগ থেকে আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায়ে বিচারক দন্ডিত আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকরের অনুমতির জন্য রায় ও মামলার নথি হাই কোর্টে পাঠাতে বলেন।

খালাস এক আসামি : সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারার অভিযোগ থেকে আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দিয়েছে আদালত। তাকে খালাস দেওয়ার বিষয়ে রায়ে বলা হয়েছে, আসামি মো. মিজানুর রহমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে দোষ দেখা যায়নি। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামি মো. মিজানুর রহমান হোলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে জড়িত কিংবা হোলি আর্টিজান হামলা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কাজেই আসামি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ৬(২)(অ) ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

দন্ড যেন বহাল থাকে সেই চেষ্টা করব-অ্যাটর্নি জেনারেল : হোলি আর্টিজান মামলার রায় ঘোষণার পর গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যে জঙ্গিদের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করছে, আজকের এ রায়ে তা প্রমাণ হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে আরও উজ্জ্বল হবে। তিনি বলেন, ‘এ মামলার ডেথ রেফারেন্স যদি হাই কোর্টে আসে, আমরা চেষ্টা করব দন্ড যেন বহাল থাকে। এ মামলার রায় আমাদের দেশ যে জঙ্গিবাদ উৎপাটনের ক্ষেত্রে আন্তরিক এবং খুবই পারঙ্গম, এটাই প্রমাণ করে।’

সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ : হোলি আর্টিজান মামলার রায়ে নব্য জেএমবির সাত জঙ্গির সর্বোচ্চ সাজার আদেশ আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু। গতকাল রায়ের পর ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত প্রাঙ্গণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। একজনের খালাসের বিষয় আমরা পর্যালোচনা করে যদি মনে করি আপিল করা যাবে, তাহলে আপিল করব।’

উচ্চ আদালতে যাবে আসামিপক্ষ : রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট হলেও হতাশা প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আসামিপক্ষের আইনজীবী দোলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। সাক্ষীদের নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’

ফিরে দেখা : ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশান-২-এ হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলা চালান জঙ্গিরা। এ হামলায় জঙ্গিরা হত্যা করেছিলেন ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে, যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয় ও ৩ জন বাংলাদেশি। হামলার পরদিন ২ জুলাই সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় মামলা করা হয়। গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি তদন্ত করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই। হামলায় জড়িত মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকেই কেবল আসামি করা হয়। আট আসামির মধ্যে শরিফুল ও মামুনুর ছাড়া বাকি ছয় আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে গত বছর ২৬ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠন হয়। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। চলতি বছর ২৭ অক্টোবর শেষ হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২১১ জনকে সাক্ষী করলেও ১১৩ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৭ নভেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন বিচারক। রায় হওয়া আট আসামি ছাড়া হামলার সঙ্গে জড়িত বাকি আসামিরা হলেন- তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান। এরা সবাই অভিযানে নিহত হয়েছেন।

রায় মাইলফলক বলল যুক্তরাষ্ট্র : গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলার বিচারকে বাংলাদেশের জন্য ‘মাইলফলক’ বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বাংলাদেশের আদালতে ওই মামলার রায়ের পর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক ফেসবুক পোস্টে এই প্রতিক্রিয়া জানায়।

কৃতজ্ঞ ফারাজের পরিবার : সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করায় সরকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় অন্যতম নিহত ফারাজ হোসেনের পরিবার। গতকাল ফারাজের ভাই যারেফ হোসেন পরিবারের পক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 

আহত কর্নেল তুহিন ও এসপি আবদুল আহাদের প্রতিক্রিয়া : চাঞ্চল্যকর হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ওই ঘটনায় আহত কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ ও এসপি আবদুল আহাদ। তারা বলেছেন, রায়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। দ্রুত এ রায় কার্যকর হবে বলে প্রত্যাশা করি।

হোলি আর্টিজান বেকারি থেকে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তৎকালীন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (বর্তমানে বিজিবির রাজশাহী ক্যাম্পের সেক্টর কমান্ডার) কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ ও গুলশান জোনের এডিসি (বর্তমানে এসপি) আবদুল আহাদ।

কর্নেল মাসুদ বলেন, রাত সোয়া ৯টা। তখন তারাবির নামাজ পড়ছিলাম। এ সময় র‌্যাব ডিজির একটা কল রিসিভ করি। তিনি জানান, কোন রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে বিদেশিদের কেউ জিম্মি করেছে কিনা। আমি খবর নিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। দ্রুত হোলি আর্টিজান বেকারিতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি আশপাশে পুলিশ অবস্থান নিয়েছে। তিনিও পাশের ভবনের ওপর থেকে দেখার চেষ্টা করলেন ভিতরে কী হচ্ছে। র‌্যাব সদস্যদেরও ভবনটি ঘিরে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এর কিছুক্ষণ পরই পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের (জঙ্গি) সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তখন জঙ্গিরা একটি আইইডি দিয়ে হামলা করে। বিস্ফোরণের পর পরই দেখলাম আমার দুই পাশে দুজন পড়ে গেলেন। একজন এসি রবিউল ইসলাম এবং অপরজন ওসি সালাহউদ্দিন। কর্নেল মাসুদ বলেন, বিস্ফোরণের পর পরই সবাই পেছন দিকে সরে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসি রবিউল এবং ওসি সালাহউদ্দিন মারা যান। বিস্ফোরণে আরও প্রায় ২০ জনের মতো আহত হয়েছিল। মনে হলো আমার পায়ের মধ্যে গরম কিছু একটা আঘাত করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্লিডিং শুরু হলো। তখন বুঝতে পারলাম আমারও কিছু একটা ক্ষতি হয়েছে, ‘নিজের পায়ে নিজেই ব্যান্ডেজ করে নিই’। ওই সময়ে পুলিশের গুলশান জোনের দায়িত্বে থাকা এসপি আবদুল আহাদ সেই বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে এখনো শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর