বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেদিন কী হয়েছিল হোলি আর্টিজানে

মির্জা মেহেদী তমাল

সেদিন কী হয়েছিল হোলি আর্টিজানে

হোলি আর্টিজানের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চালানো সেনা অভিযান -ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বর্বরোচিত ও নিকৃষ্ট জঙ্গি হামলা হয় কূটনৈতিক এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে। যে হামলা পুরো দেশসহ স্তম্ভিত করে দেয় বিশ্বকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এই হামলাটি ছিল বজ্রপাতের মতো। পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে জঙ্গি মোকাবিলায় অংশ নিতে ঘটনাস্থলে আসে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ এর সফল অভিযানের পর ভয়ঙ্কর রাত শেষে পরদিন সকালে স্বস্তি ফিরে আসে। সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত দেশসহ সারা বিশ্বের মিডিয়াতে গুরুত্ব সহকারে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।

পুলিশের তদন্ত, আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানিতে শান্ত সন্ধ্যাটা যেভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, সেসব ঘটনার চিত্র ফুটে উঠেছে। অভিযোগপত্রে সে রাতের রেস্তোরাঁর বর্ণনায় বলা হয়, প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত ছিল শুক্রবারের (১ জুলাই, ২০১৬) সন্ধ্যা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত রেজা করিম (হাসনাত করিম) মেয়ের জন্মদিন পালন করতে এসেছিলেন স্ত্রী শারমিনা পারভীন ও দুই সন্তানকে নিয়ে। তারা বসেছিলেন হলরুমের পেছনের অংশে। তাহমিদ হাসিব খান, ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া এসেছিলেন রাত ৮টা ১০ মিনিটে। লনের লেকপাড় ঘেঁষা টালি ঘরটিতে বসেছিলেন তারা। ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ রাত সাড়ে ৮টায় পাস্তা অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বন্ধু তন্ময়ের জন্য। ফারাজ আয়াজ হোসেন, তারিশি জৈন ও অবিন্তা কবির বসেছিলেন হলরুমে। ৯ জন ইতালীয় রেস্তোরাঁয় এসেছিলেন বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ। তারা বসেছিলেন নিচতলার একেবারে সামনের টেবিলে। তারা সবাই বাংলাদেশে পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ইতালীয়দের পরই রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলেন জাপানি নাগরিকরা। তাদের বড় অংশই বনানীর জাইকা অফিসের কর্মকর্তা। ঢাকার ইশরাত আখন্দ বসেছিলেন তার শ্রীলঙ্কান বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে। আর সব দিনের মতোই সবকিছু ছিল স্বাভাবিক। হাসি-আনন্দে মুখর হোলি বেকারির সন্ধ্যাবেলা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল রাত পৌনে ৯টার দিকে।

নিরাপত্তারক্ষী নূরে আলম আদালতে সাক্ষ্যে বলেছেন, ১ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত ফটকের দায়িত্বে তিনি ছিলেন। রাত পৌনে ৯টার দিকে পাঁচ তরুণকে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে দেখে তিনি তাদের পরিচয় জানতে চান। জবাব না দিয়েই তারা রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে যান। থামতে বললে তরুণদের একজন ‘ওই ব্যাটা, সর’ বলে নূরে আলমের নাকের নিচে ঘুষি দিয়ে ভিতরে ঢুকে যান।

হোলি আর্টিজানের অতিথিরা তখনো ওই যুবকদের পরিচয় জানেন না। ভেবেছিলেন, ওরাও তাদের মতোই অতিথি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা আল্লাহু আকবার বলে গুলি ছুড়তে থাকেন। তারা বলতে থাকেন, ‘তোমাদের ভয় নাই, আমরা মুসলমানদের মারব না, টেবিলের নিচে মাথা নিচু করে থাকো।’ হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন সাক্ষ্যে বলেন, হামলাকারীরা বলেন যে মুসলমানদের কোনো সমস্যা নেই। এরপরই তারা ৮-১০ জন বিদেশি নাগরিককে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। কিছুক্ষণ পর দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে এবং এক ব্যক্তিকে হামলাকারীরা তাদের (শারমিনা পারভীন) টেবিলের কাছে বসান। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটারের পাশে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় বিদেশি এক নাগরিককে। শারমিনা পারভীন আদালতে বলেন, ‘ডেডবডি ছড়ানো ছিল আমাদের চারপাশে। সেগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর শব্দ পাই।’ এ সময় রেস্তোরাঁর কর্মীদের কেউ কেউ পালিয়ে পাশের লেকভিউ ক্লিনিকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সমীর বাড়ৈসহ কর্মীদের কয়েকজন লুকিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। সমীর আদালতে বলেন, তারা রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ ওয়াশরুমে ধাক্কাধাক্কি শুনতে পান। বাইরে থেকে কেউ বলে দরজা না খুললে বোমা মেরে উড়িয়ে দেব। তারা দরজা খুলে দেখেন আগ্নেয়াস্ত্র ও চাপাতি হাতে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। সমীরসহ সেখানে থাকা সবাই বাংলাদেশি নিশ্চিত হয়ে তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে দেন ওই দুজন (হামলাকারী জঙ্গি)। এরপর পর্যায়ক্রমে টয়লেট, ছাদ, কিচেন, চিলাররুমে লুকিয়ে থাকা বিদেশিদের খুঁজে বের করে গুলি ও ধারালো ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। নিরীহ লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলার পরও লাশগুলো কুপিয়েছিল জঙ্গিরা। চোখের সামনে জঙ্গিদের এমন নৃশংস আচরণ দেখেন ওই সময় হোলি আর্টিজানে জিম্মি হয়ে পড়া ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া। দুজনই আদালতে দেওয়া তাদের জবানবন্দিতে ভয়াবহ সেই ঘটনার বর্ণনা দেন। ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সে রাতে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির মধ্যে মীর সামেহ মোবাশ্বের ও নিবরাস ইসলাম হোলি আর্টিজানের এক পাশ থেকে এবং অন্য পাশ থেকে রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল প্রবেশ করে। তারা প্রথমেই হত্যা করে ইতালীয়দের। একপর্যায়ে হামলাকারীরা অতিথিদের ফোন ব্যবহার করে হোলি আর্টিজানের নৃশংসতার ছবি পাঠাতে শুরু করে তামিম আহমেদ চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে। মানুষ দ্রুতই জেনে যায় হোলি আর্টিজানের দখল নিয়েছে জঙ্গিরা। রাত ১১টার মধ্যেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। 

রেস্তোরাঁর বাইরে যুদ্ধ : গুলিবর্ষণ করতে করতে জঙ্গিরা হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে। ঘটনাস্থলে শুরুতেই আঘাতপ্রাপ্ত হন দুই কনস্টেবলসহ এক পথযাত্রী। দুই কনস্টেবল আহত হওয়ার পরপরই পুলিশ খারাপ কিছু সন্দেহ করতে থাকে। পুরো রেস্তোরাঁটি তখন ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে গুরুতর আহত হন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসি রবিউল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তারা। এরপর তুমুল সংঘর্ষ বাধে। রীতিমতো যুদ্ধ। রাত ১১টার দিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান ‘ভিতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন। ভিতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমরা বিপথগামী হামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি।’ রাত ১২টায় পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে অভিযানে অংশ নিতে ঘটনাস্থলে আসে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। সারা রাত জঙ্গিদের সুযোগ দেওয়া হয় আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় ২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করা হয়। মাত্র ১৫ মিনিটের অভিযানেই ৫ জঙ্গি নিহত হয়।

আটকে পড়াদের উদ্ধার : অপারেশন থান্ডারবোল্ট শেষে রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে একজন জাপানি, দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ১২ ঘণ্টার এ জিম্মি ঘটনায় নিহত হন ২৪ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি।

সর্বশেষ খবর