সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পার্বত্য সন্ত্রাসে ম্লান উন্নয়নের সাফল্য

শান্তিচুক্তির ২২ বছর আজ

শিমুল মাহমুদ

তিন পার্বত্য জেলায় ধারাবাহিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দেশের এক-দশমাংশ ভূখন্ডের এই তিন জেলায় খুন, অপহরণ, সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত জনজীবন। গত এক বছরে তিন জেলায় অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকা  সংগঠিত হয়েছে। এমনকি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় সেনাবাহিনীর সদস্যও খুন হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে বহুল আকাক্সিক্ষত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির দুই দশক পেরিয়ে গেলেও সমৃদ্ধির জনপদ তিন জেলায় কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরে আসেনি। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পারস্পরিক বিরোধ, অব্যাহত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে পার্বত্য জনপদে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হলেও সাম্প্রতিক সন্ত্রাসে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পার্বত্য জেলাগুলোতে বিদ্যমান সশস্ত্র গ্রুপগুলোর আধিপত্য বিস্তার, সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অব্যাহত চাঁদাবাজি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে পাহাড়ের পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি ভেঙে এখন চার টুকরো। এই চার সংগঠনের প্রভাবিত এলাকায় সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত জীবনযাপন করছে। শান্তিচুক্তির আলোকে পার্বত্য এলাকা থেকে অধিকাংশ সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করায় সশস্ত্র পার্বত্য অপরাধীদের খুন, অপহরণ, চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্মে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, সরকারের প্রচেষ্টায় চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন।  

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রমতে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এ পর্যন্ত সামাজিক অপরাধের বাইরে তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩৫০ জন। অপহৃত হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি। নিহতদের অধিকাংশই বাঙালি। বাঙালিরা খুন হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে। অন্যদিকে পাহাড়িদের অধিকাংশই নিহত হয়েছে দলীয় কোন্দলের কারণে। গত এক বছরে কয়েকটি সশস্ত্র হামলায় নিহতদের প্রায় সবাই আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থের বলি।

সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হলেও তিন পার্বত্য জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। আগে সেখানে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর কাছে জনপ্রতি অস্ত্র ছিল না। এখন তাদের কাছে উদ্বৃত্ত অস্ত্র রয়েছে। তারা সেগুলো সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজিতে ব্যবহারের পাশাপাশি দেশের অন্য এলাকায় কালোবাজারে বিক্রি করে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী এক ব্রিগেড সৈন্যসহ ৩৫টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু শান্তিচুক্তির মূল এজেন্ডা জনসংহতি সমিতিসহ সশস্ত্র গ্রুপগুলো অস্ত্র সমর্পণের পরিবর্তে নিজেরা অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। বিশেষজ্ঞ মতে, তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বাঙালি। বাকি ৫২ শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিবাসী। অথচ ৪৮ শতাংশ বাঙালিকে পার্বত্য জেলা থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে এবং পার্বত্য তিন জেলা পাহাড়িদের একক আধিপত্যে আনতে কাজ করছেন জনসংহতি সমিতির নেতারা। সূত্র জানায়, পার্বত্য জেলাগুলোতে অধিকাংশ বিরোধ জমি নিয়ে। শান্তিচুক্তির আলোকে সরকার ভূমি কমিশন গঠন করে ২০০১ সালে। কমিশন নিয়ে উপজাতীয় নেতাদের আপত্তির কারণে সরকার ২০১৭ সালে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে। তারপরও কমিশন কাজ করতে পারছে না। ভূমি কমিশন কার্যকর হোক এটা তারা চায় না। পার্বত্য সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য জেলা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের জন্য সরকারি খাস জমিতে বসবাসকারী বাঙালিদের জমিকে নিজেদের জমি দাবি করে পাহাড়িরা। রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ হিসেবেই তারা এটা করছে। চুক্তির আলোকে সরকার ভূমি জরিপ করতে চাইলেও সেটা করতে দিচ্ছে না পার্বত্য গোষ্ঠীগুলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর দুর্গম অঞ্চলগুলো থেকে সেনাক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এখন শুধু রোড সাইড ক্যাম্পগুলো বহাল রয়েছে। তারপরও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ কমছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙামাটি সদরের একজন স্কুলশিক্ষক বলেন, পাহাড়ে সেনাবাহিনী না থাকলে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মতোই কচুকাটা করে তাড়িয়ে দেবে। তিন জেলায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কোনো সরকারি প্রশাসন থাকবে না যা তারা সব সময় চায়। সূত্র জানায়, তিন পার্বত্য জেলায় প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে র পেছনেই রয়েছে চাঁদাবাজি। চাষাবাদ, গাছ কাটা, বাগান তৈরি, পণ্য পরিবহনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা দিতে হয়। কাক্সিক্ষত চাঁদা না পেলে তারা খুন, অপহরণসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য, জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান সন্তু লারমা মাঝে মাঝেই ‘বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা হয়নি’ বলে সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অথচ শান্তিচুক্তির কোনো ধারা-উপধারাতেই বাঙালিদের অন্যত্র পুনর্বাসনের উল্লেখ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে একটিই প্রত্যাশা, সেটি হচ্ছে, অস্ত্র সমর্পণ করে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেটিই করা যাচ্ছে না রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কারণে। পাহাড়ের প্রকাশ্য সংগঠনগুলো এসব সশস্ত্র সংগঠনকে মদদ দেয় বলে সূত্র জানায়।

সূত্র জানায়, তিন পার্বত্য জেলায় ‘চাঁদা’ না দিয়ে বসবাস করার কোনো সুযোগ নেই। শুধু ব্যবসায়ী নন, সরকারি চাকুরে, এনজিও, মুদি দোকানি, সাধারণ মানুষসহ সবাই ‘চাঁদা’র নামে সন্ত্রাসীদের অর্থ দিতে বাধ্য। অর্ধবার্ষিক কিংবা বার্ষিক হারে সেই চারটি সংগঠনকে চাঁদা দিয়ে ‘কার্ড’ জোগাড় করতে হয়। কথিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অর্থ, অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করা। ‘চাঁদা’র দাবিতে খুনের পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক সংঘাত এবং খুনের বদলা নেওয়ার কারণেও মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।

পাহাড়ে অস্ত্রবাজি, খুন ও হানাহানি সম্পর্কে জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা সন্তু লারমা গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, একটি বিশেষ মহলের ইন্ধনে অন্য পাহাড়ি সংগঠনগুলো এসব করছে। তার জনসংহতি সমিতি এসবের সঙ্গে জড়িত নয় বলে তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর