বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভুঁইফোড় সংগঠনে সয়লাব আওয়ামী লীগ

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে সংগঠনের শেষ নেই, অনুমোদন নেই মূল দল ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের, রয়েছে চাঁদাবাজি সন্ত্রাসের অভিযোগ, নিষিদ্ধের দাবি বিশেষজ্ঞদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভুঁইফোড় সংগঠনে সয়লাব আওয়ামী লীগ

রকমারি লীগে সয়লাব আওয়ামী লীগ। কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে বেড়েই চলেছে এসব ‘লীগ’। এদের কোনো অনুমোদন নেই মূল দল ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের। তার পরও পরগাছার মতো বেড়ে উঠছে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন।

নামের আগে ‘লীগ’ বসিয়ে দেদার চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকা  চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে। দলের কাজে না এলেও বদনামের ভাগীদার হতে হচ্ছে এসব সংগঠনের বিতর্কিত কর্মকান্ডে র কারণে। অতিদ্রুত এসব ভুঁইফোড় সংগঠন নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। ধান্দাবাজি আর চাঁদাবাজির মতলবেই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে এরা গজিয়ে  ওঠে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। সূত্রমতে, দল যখন ক্ষমতায় না থাকে তখন এদের দেখা মেলে না। ক্ষমতায় এলেই ওরা গড়ে তোলে নিত্যনতুন লীগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে একের পর এক সংগঠন আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের পেছনে ‘লীগ’ শব্দ জুড়ে তো দিচ্ছেই, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যের নামও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করেও নিজের জানান দিচ্ছে অনেক সংগঠন। কয়েক মাস ধরে নানা অপকর্মের কারণে বারবার আলোচনায় আসছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠনের নাম। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি, সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলার মতো একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নূর ও তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীদের ওপর চড়াও হয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ আবার আলোচনায় এসেছে। মঞ্চের হামলায় ভিপি নূরসহ অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। চলতি বছরে এ মঞ্চে ভাঙন হয়েছে, দুটি পক্ষ একে অন্যকে বহিষ্কার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে কেন এমন করা হচ্ছে? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। সংগঠনটি গঠনের পরপরই এতে ভাঙন হয়। মূল সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে যায় সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এতে দুই অংশই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নাম ব্যবহার করে উগ্র আচরণ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মূল অংশটি কথাবার্তায় ‘সক্রিয়’ ও উগ্রতা ছাড়ালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাটি নিজেদের মূল মঞ্চ দাবি করে মারমুখী সব কর্মসূচি পালন করতে থাকে।

এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বরং ক্রমান্বয়ে বাড়ছে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের সংখ্যা। প্রকাশ্যে প্রায় প্রতিদিনই ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেলেও যেন দেখার কেউ নেই আওয়ামী লীগে। এদের একজনের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে যেসব অপকর্ম হচ্ছে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছে দেশের রাজনৈতিক সচেতন মহল।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডে র বিষয়ে জানতে চাইলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে যত্রতত্র সংগঠন গড়ে উঠছে। তাদের কার্যক্রম যথেষ্ট বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লীগ শব্দটি ব্যবহার কিংবা সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ও সরকারের একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেখা যায় যে, অনুপ্রবেশকারী, সুযোগসন্ধানীরা দল ও সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণœ করছে। তারা ঐতিহাসিক নামগুলোর সম্মান অবমাননা ও ক্ষতি করছে। এ ধরনের নামের অপব্যবহার করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিরা বসে নেই। ফলে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুসহ ঐতিহাসিক নামগুলোর যেন বিকৃত ব্যবহার না হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দুটি বা তিনটি নির্বাচনে বিজয় লাভ করাই শেষ কথা নয়।’

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত আটটি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগ ও মৎস্যজীবী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলো ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ। দলের গঠনতন্ত্রে এর বাইরে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। বাকিসব ভুঁইফোড়। এসব সংগঠনের দায় নেতারা নিতে না চাইলেও বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, তাদের নানা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এমনকি মন্ত্রীদেরও সহাস্য উপস্থিতি দেখা যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠছে মূলত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে। আর এই শাস্তিহীনতার সুযোগ নিয়ে এর অপব্যবহার করছে সুবিধাভোগী মহল। তারা বলছেন, ভুঁইফোড় এসব সংগঠন মূলত লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুনসর্বস্ব। বাস্তবে এসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম যেমন নেই, তেমন নেই কোনো কার্যালয়ও। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো নেতার ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন ছাপানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজধানীসহ সারা দেশের অলিগলিতে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের বড় বড় ছবি দেখা যায়। কিন্তু এদের একজনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এ প্রসঙ্গে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখন কোনো প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে, তখন তাকে ভর করে অনেক আগাছা-পরগাছার জন্ম হয়। এখন নদীর পাড় দখল করা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে। অর্থাৎ কেউ যেন দখলকৃত জায়গা ভাঙতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হয়। এরা সরকারের উইপোকা। এসব উইপোকা বংশ বিস্তারের আগেই নিধন করা প্রয়োজন।’ অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বাইরে থাকা শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে- বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী পর্যটন লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, আমরা নৌকার প্রজন্ম, আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গমাতা সাংস্কৃতিক জোট, তৃণমূল লীগ, একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি, আমরা মুজিব হব, চেতনায় মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা ও এতিমখানা উন্নয়ন পরিচালনা কমিটি, আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ লীগ, অভিভাবক সচেতনতা লীগসহ বিভিন্ন নামের দুই শতাধিক সংগঠন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর