বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি

উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও

আরাফাত মুন্না

উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি করতে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় বাস্তবায়ন হয়নি আজও। ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে দেওয়া ওই রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞাসহ তা রোধে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিল হাই কোর্ট। এরপর কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দায়সারাভাবে কমিটি করেছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলোতে ওই কমিটি নেই বললেই চলে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার কমিটি করলেও হাই কোর্টের নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণও করেনি। জানা গেছে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে সেটাই জানেন না অধিকাংশ শিক্ষার্থী বা কর্মজীবী নারী। ওই রায়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে আইন ও বিধিমালা করার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা-ও করেনি সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাবেই হাই কোর্টের দেওয়া রায় উপেক্ষিত রয়েছে। তাই প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। নিপীড়নের ঘটনায় প্রতিকারও পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। গত এপ্রিলে ১০ বছর আগে দেওয়া রায়ের কার্যকারিতা চেয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ ছয় সংগঠনের পক্ষে অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ হাই কোর্টে রিট করেন। সে সময় হাই কোর্ট বলেছে, উচ্চ আদালতের রায়ের পরও যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠনে অবহেলা হতাশাজনক। শুনানি শেষে হাই কোর্ট রায় কার্যকর প্রশ্নে রুল জারি করে।

গত বছর অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ বিষয়ে একটি গবেষণা চালায়। তাতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন নারী শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের কথা জানে না ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, আদালতের নির্দেশনার কথা জানে না ৮৭ শতাংশ। আর ওই নির্দেশনার কথা কেবল শুনেছে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে জানে না ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং নির্দেশনার কথা জানে কিন্তু বিস্তারিত জ্ঞান নেই ১৪ শতাংশের। গবেষণায় তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি থাকার তথ্য মেলে। ২০০৯ সালে হাই কোর্টের দেওয়া ওই রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ কেন্দ্র গঠন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ না করার কথাও বলা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অভিযোগ কেন্দ্র থাকবে। এই অভিযোগ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। আর কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী। এ ছাড়া কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী সদস্য থাকবেন। কমিটি যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠাবেন। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা বুঝে বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। রায়ে আরও বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে যৌন হয়রানি রোধে কোনো আইন প্রণয়ন করা না হয় ততদিন বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাই কোর্টের দেওয়া এ নীতিমালা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ১০ বছর আগে উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া রায় বাস্তবায়ন না হওয়া খুবই দুঃখজনক। এজন্য আমরা আবারও হাই কোর্টে গিয়েছি। প্রতিবেদন চেয়েছি। কোর্ট রুল জারি করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অনেকগুলো ভালো আইন করেছে। আমরা আশা করি, হাই কোর্টের ওই রায় অনুযায়ী নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনটিও বর্তমান সরকারই করবে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। রায়ের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়া খুবই হতাশাজনক। এই রায় বাস্তবায়ন হলে যৌন হয়রানি অনেকটাই কমে আসবে। যৌন হয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা চেয়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী হাই কোর্টে রিট আবেদনটি করেছিলেন। ওই রিট নিষ্পত্তি করে ২০০৯ সালের ১৫ মে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞাসহ যৌন হয়রানি রোধে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে প্রথম যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও আইন করার দাবি উঠেছিল। ওই সময় ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে নীতিমালার একটি খসড়া জমা দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় নানা জায়গা থেকে একই দাবি আসতে থাকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর