সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা ২০১৯

ক্যাসিনো-বালিশ ডিআইজি মিজান জাহালম বাছিরে আলোচিত দুদক

আহমেদ আল আমীন

অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, মামলা ও অভিযানসহ কর্মমুখর আরও একটি বছর পার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, রূপপুর প্রকল্পে বালিশ কেলেঙ্কারি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও টেন্ডারবাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বিদায়ী ২০১৯ এর শেষদিকে ব্যাপক আলোচনায় ছিল দুদক। এ ঘটনায় আলোচিত কয়েকজনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। আরও অনেক অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিকের বাসা থেকে ঘুষের ৮০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল দুদকের অন্যতম সাফল্য। দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে বেশ কিছু গণশুনানির আয়োজন করে কমিশন। হটলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে বছরজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতিবিরোধী সরেজমিন অভিযান চালিয়েছে সংস্থাটি। তবে পুলিশের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ডিআইজি মিজানুর রহমানের সঙ্গে দুদকের তৎকালীন পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের ঘুষ লেনদেনের পাশাপাশি কমিশনের মামলায় নির্দোষ জাহালমের আসামি হওয়ার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনা দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাময়িকভাবে প্রশ্নের মুখে ফেললেও সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের তাৎক্ষণিক কার্যকর পদক্ষেপে হারানো ইমেজ দ্রুত ফিরে পায় কমিশন। দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বরাবরের মতোই বছরব্যাপী দুদকের সক্রিয় অবস্থান ছিল। ক্যাসিনোকা  ও বালিশ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে। আবার দুর্নীতির অভিযোগ আসায় দুদকের কর্মকর্তাদেরও ছাড় দেয়নি কমিশন। ব্যক্তির অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না।

অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ প্রকাশের পর ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর একে একে গ্রেফতার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা জি কে শামীমসহ যুবলীগ ও কৃষক লীগের অনেকে। ঢাকার দুই সিটির তিনজন কাউন্সিলরের পাশাপাশি এ ঘটনায় সরকারদলীয় হুইপসহ তিনজন সংসদ সদস্যেরও নাম উঠে আসে। ক্যাসিনোবাজদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি কমিশনের তফসিলভুক্ত বলে ৩০ সেপ্টেম্বর টিম গঠন করে অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। ইতিমধ্যে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। অনুসন্ধান শেষে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এনামুল হক আরমান, লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও সেলিম প্রধানসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কমিশন। দুদকের মামলায় আসামি হয়েছেন ঢাকার দুই সিটির কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান, এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ ও তারেকুজ্জামান রাজীবও। জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীসহ দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় এসেছেন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনও। গণপূর্ত অধিদফতরের কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বালিশকা সহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১২ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ৩১ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় করা এই মামলায় ওইদিনই আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে কমিশন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনায় সিলেটের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এর আগে ২৮ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে ঘুষের ৮০ লাখ টাকাসহ তাকে গ্রেফতার করে কমিশন।

সরকারি দফতরে সেবা পেতে হয়রানি বা দুর্নীতির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে বেশ কিছু গণশুনানির আয়োজন করেছে দুদক। এসব শুনানিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক অভিযোগের তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে স্থাপিত টোল ফ্রি হটলাইনের মাধ্যমে এখতিয়ারভুক্ত অপরাধের প্রতিকার ও প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে দুদক। হটলাইনের ১০৬ নম্বরে অসংখ্য অভিযোগ ও কল এসেছে। ঘুষ, অবৈধ সম্পদ, অর্থ পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ তফসিলভুক্ত অপরাধের অভিযোগের জবাবে তাৎক্ষণিক অভিযানের পাশাপাশি তফসিল বহির্ভূত অভিযোগ পেলেও দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। কমিশনের জনসংযোগ ও আইসিটি শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই থেকে গত জুলাই পর্যন্ত হটলাইনে সাধারণ মানুষের প্রায় ৩১ লাখ ফোনকল এসেছে। এই ফোনের ভিত্তিতে গত দুই বছরে ৬২৬টি প্রতিরোধমূলক অভিযান চালিয়েছে কমিশন। দুদক মনে করে, হটলাইনের মাধ্যমে সারা দেশের দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। দুদকে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে বছরজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতিবিরোধী সরেজমিন অভিযান চালিয়েছে সংস্থাটি। ২৩ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরে তিতাস গ্যাসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করে ডায়িং ফ্যাক্টরি পরিচালনা করার অভিযোগে অভিযানে যায় দুদক। হটলাইনে অভিযোগ পেয়ে দুদক অভিযানে গিয়ে ৩টি ফ্যাক্টরিতে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে।

গত জুনে দুদক আইনের সংশোধিত বিধিমালার গেজেট প্রকাশিত হয়। এই বিধিমালার বলে দুর্নীতির যে কোনো অভিযোগে দুদক কার্যালয়েই মামলা করে কমিশন। তবে সম্প্রতি বিষয়টির বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে এতসব কর্মকান্ডে র মধ্যে হঠাৎ করেই ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এনামুল বাছিরের ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়ে দুদক। ৯ জুন গণমাধ্যমে ডিআইজি মিজান দাবি করেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয় কমিশন। এরই অংশ হিসেবে বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে কমিশন। পরে ১৬ জুলাই ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে বাছির ও মিজানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মিজানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় আসামি আবু সালেকের স্থলে পাটকল শ্রমিক টাঙ্গাইলের জাহালমের কারাবাসের ঘটনাও দুদকের জন্য বিব্রতকর ছিল। এ ঘটনায় জড়িত দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর