ফের বেপরোয়া রাজধানীর নয়াবাজারে চোরাচালানের গডফাদার আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুলের সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে কাস্টমস বন্ডের দুঃসাহসিক ঝটিকা অভিযানে প্রায় ১০০ টন অবৈধ বন্ডেড কাগজ আটক করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। ভয়ে পালিয়ে গেছে চোরাকারবারিরা। এরা শুরুতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। চোরাকারবারিরা কাগজ মার্কেটের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে। পরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দিনভর অভিযান চালায় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার এস এম হুমায়ুন কবীর গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিযান এখনো চলছে। মাত্র তিনটি গুদাম থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় ১০০ টন বিভিন্ন ধরনের অবৈধ বন্ডেড কাগজের মূল্য প্রায় সোয়া কোটি টাকা। এসব অবৈধ বন্ডেড পণ্যের ব্যবসার উৎস, মাধ্যম, গন্তব্য ও জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ জানা গেছে, নয়াবাজারের বন্ডের গডফাদার খ্যাত আবুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন এক ডজন চোরাকারবারির নানা দৌরাত্ম্যেই কাগজসহ দেশীয় শিল্প খাত রীতিমতো ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েছে। তারা বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্যের বাধাহীন বাজার গড়ে তুলছে। তারাই নানা প্রতিযোগিতার মুখে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সংঘবদ্ধ ওই চক্র এতই প্রতাপশালী যে, তাদের কাছে সরকারের দায়িত্বশীল মহলও জিম্মি হয়ে পড়েছে। পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকার আবুল হোসেন মার্কেটের কর্ণধার ‘বন্ড গডফাদার আবুল হোসেনের’ আধিপত্যের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করারও উপায় নেই। এ গডফাদার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কথা বলে নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ। আরও জানা গেছে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের পর্যন্ত সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনোভাবেই এসব গডফাদারকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই রাঘব-বোয়ালদের প্রকাশ্য চোরাচালান নিয়ে পুলিশের নির্বিকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে ধ্বংসের কব্জা থেকে কাগজশিল্পকে কোনোভাবেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। আবুল হোসেনের সিন্ডিকেট প্রতিবছর সরকারি বই মুদ্রণের আগমুহূর্তে বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির নানা পাঁয়তারা চালিয়ে থাকে। এভাবে চোরাচালানে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় কাগজশিল্প। এ শিল্প রক্ষায় সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির নির্দেশনার আলোকে ঝটিকা অভিযানে নেমেছে কাস্টমস বন্ড। গতকাল সরেজমিন নয়াবাজার জিন্দাবাহার লেনের চান মিয়া পেপার মার্কেট ও আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেলা ২টার সময় মার্কেটটি ঘিরে রাখে কাস্টমস বন্ড ও পুলিশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দেড় শতাধিক সদস্যের একটি টিম। এ সময় কাগজ চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী চক্রের হোতারা দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যায়। এ সময় মাইকে কাস্টমস কর্মকর্তারা ঘোষণা দেন দ্রুত দোকান খোলার জন্য। এতে কেউ সাড়া দেয়নি। তখন পুলিশসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে তল্লাশি চালায় কাস্টমস। পরে সবার উপস্থিতিতে চোরাকারবারিদের দোকানগুলোর তালা ভেঙে অভিযান চালায় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানটির উপকমিশনার রেজভী আহমেদ, সহকারী কমিশনার আল-আমিন, শরীফ মোহাম্মদ ফয়সাল, মো. আকতার হোসেন যৌথভাবে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। দেড় শতাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ভ্যাট অফিসের পাশাপাশি সিআইডি, ডিএমপি সদর দফতর ও পুলিশ অভিযানে সহায়তা করে বলে জানিয়েছে কাস্টমস।
অভিযানের সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে ঘটনাস্থল থেকে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) মো. আল-আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জিন্দাবাহার লেন এলাকার চান মিয়া পেপার মার্কেট ও আশপাশের গুদামে ঝটিকা অভিযান চলছে। যদিও অভিযানের শুরুতেই অবৈধ বন্ডেড পণ্যের ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। এখন পুরো পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’জানা গেছে, অভিযানে উদ্ধার হওয়া এসব কাগজ বিভিন্ন বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা হয়। পরে রপ্তানিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের পরিবর্তে চোরাই পথে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায়যোগ্য শুল্ক-করাদির পরিমাণ প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। আটক পণ্যের বিপরীতে মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ চলমান।
এদিকে নয়াবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যরাতে পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকায় আবুল হোসেন মার্কেটের আঙ্গিনাতেই বন্ড সুবিধায় আনা কাগজ লোড-আনলোড হয়। সেখানে পুলিশ ছাড়াও আবুল হোসেনের পোষ্য মাস্তান দল পাহারায় থাকে। সিন্ডিকেটই তাদের নেতৃত্ব বহাল রাখে। এ সিন্ডিকেটই চোরাকারবারি নিশ্চিত রাখে। নেতৃত্বের ক্ষমতা দিয়েই আবুল যখন যাকে খুশি হুমকি-ধমকি দেন, কাগজের বাজার বন্ধ করার ভয় দেখান।
সরেজমিনে কাগজের সবচেয়ে বড় খোলাবাজার নয়াবাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুল্ক সুবিধায় আনা কাগজ প্রায় প্রতিটি দোকানেই বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, সাধারণত রাত ১১টার পর থেকে বন্ডের মাধ্যমে আনা পণ্য লোড-আনলোড হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আবুল হোসেন বলতে পারবেন। তিনিই এ ব্যবসার মূল হোতা। পুরো নয়াবাজারের পেপার মার্কেট তার নিয়ন্ত্রণে চলে। তার কথায় সবাই ওঠে-বসে। তিনিই বলতে পারবেন কে কে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবুল হোসেন বন্ডের পণ্য চোরাচালানের নেতৃত্ব দিয়ে এখন ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে তার প্রকাশ্য সখ্য রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কাস্টমস অভিযানে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় বন্ড গডফাদার আবুল হোসেনের পেটোয়া বাহিনীর হাতে। সদরঘাট ও আশপাশ এলাকায় বন্ড পণ্যের চোরাচালান ঠেকাতে বিশেষ নজরদারি এবং চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানির নামে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার বাড়ছেই। আমদানিপণ্য কালোবাজারে বিক্রি করে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চলছে। আবার আমদানির আড়ালে বেড়েছে অর্থ পাচার। সব মিলিয়ে বন্ড সুবিধায় এখন ‘পোয়াবারো’ চোরাকারবারিদের। একশ্রেণির ব্যবসায়ী বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে কালোবাজারে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আত্মসাৎ করছেন। চোরাকারবারিরা দৌরাত্ম্যে বন্ডের কার্যক্রমকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং রাজস্ব ফাঁকি এবং দেশীয় শিল্পকে হুমকির সম্মুখীন করছে।
প্রসঙ্গত, রপ্তানিতে সহযোগিতা করতে সরকার শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ দেয়। অর্থাৎ একটি রপ্তানিমুখী কারখানার উৎপাদনে ব্যবহৃত সব কাঁচামাল কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই আমদানি করা যাবে। এই শুল্কমুক্ত সুবিধা ‘বন্ড সুবিধা’ নামে পরিচিত। বন্ড সুবিধা পাওয়ার অন্যতম শর্ত থাকে, হিসাবমতো কাঁচামাল আমদানি করতে হবে এবং তা খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। আমদানিশুল্ক মুক্ত পণ্য কারখানার বন্ডেড ওয়্যারহাউসে মজুদ রেখে উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো পুনঃ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি হয়েছে দিনের পর দিন। ফলে প্রতিবছর শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হলে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।