জরুরি প্রয়োজন বা পণ্য নিয়ে চলাচল করছে দু-একটি গাড়ি। চারদিক প্রায় সুনসান। মানুষজনের সংখ্যাও কম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সড়ক। অলিগলিতেও জটলা নেই। সন্ধ্যা নামলেই পরিণত হয় ভুতুড়ে নগরীতে। নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির চতুর্থ দিনে গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে ছিল অবরুদ্ধ পরিস্থিতি। এর মধ্যেই সেনাবাহিনী পুলিশ আর র্যাবের টহল চলছে। মাইকিং করে বলছে, ‘আপনারা ঘরে থাকুন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হবেন না।’ এমন প্রচারণা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। শহর, বন্দর, গ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে ১০ দিনের টানা ছুটি শুরু হয়েছে। মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মাঠে কাজ করছে সশস্ত্র বাহিনী। মূলত সামাজিক দূরত্ব ও প্রবাসীদের সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সারা দেশেই সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের জোরদার টহল ছিল। ঘরে থাকার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাচ্ছে না। দিনে কিছু লোকজন ও যানবাহন চলাচল করলেও সন্ধ্যার পর একেবারেই কমে যায়, যে কারণে নীরব হয়ে যায় রাস্তাঘাট, মহল্লা। রাতে শহরগুলো হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ।
বন্ধের চতুর্থ দিনে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। মুদি ও ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য কোনো দোকান খোলা দেখা যায়নি। মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বাড়ির সামনে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন স্থাপন করা হয়েছে বা সাবান-বালতি রাখা হয়েছে। প্রধান সড়কসহ বড় বড় রাস্তায় ছিল পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল। ছিল না গণপরিবহন।সরকারি নির্দেশনায় গত বৃহস্পতিবার থেকে অফিস-আদালত, গণপরিবহন, বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, ট্রেন, নৌযানসহ দেশের সব কিছুই বন্ধ রয়েছে। তবে প্রয়োজন অনুসারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। সীমিত পরিসরে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ব্যাংকও খোলা থাকছে সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া। বর্তমানে শুধু চীন ছাড়া আর কোনো ফ্লাইট নেই বাংলাদেশ বিমানের।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব ও মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে টহলের পাশাপাশি মাইকিং করে সতর্কতামূলক ক্যাম্পেইন অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী। মাইকিং ছাড়াও লিফলেট বিতরণ করে সেনাবাহিনী।
ঘরে থাকার আহ্বান সাঈদ খোকনের : করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, আপনারা বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেন না। সরকার আপনাদের পাশে আছে। সিটি করপোরেশন আপনাদের পাশে আছে। আমিও আপনাদের পাশে আছি। যে কোনো সমস্যায় আমাকে আপনারা পাবেন। দয়া করে ঘরে থাকুন। গতকাল বিকালে মাসব্যাপী ছিন্নমূল খেটে-খাওয়া মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে মেয়র এ আহ্বান জানান। ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনের সামনে করপোরেশনের এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে বিদেশ থেকে আসাদের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে বাড়িতে বাড়িতে সরেজমিন পরিদর্শন করছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরের খুলশি, বায়েজিদসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তদারকি করেন। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নগরের বিভিন্ন স্থানে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকিং করে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
নেত্রকোনা : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেত্রকোনার সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলার ১০ উপজেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, মোহনগঞ্জসহ মোট ১৫টি বিওপি রয়েছে। যেগুলো দিয়ে কিছু দিন আগেও ওইসব এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী লোকজন দুই পাড়ে আসা-যাওয়া করত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইন ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসন। গতকাল সকালে কুমিল্লা সেনানিবাসের ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মো. মাহফুজ আলমের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় গিয়ে সদ্য ফেরত প্রবাসীরা হোম কোয়ারেন্টাইন মানছে কিনা তা খতিয়ে দেখেন এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় তাদের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে সচেতন করেন।
নাটোর : নাটোরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে র্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের পক্ষ থেকে টহল ও মাইকিং করা হয়েছে। র্যাব-৫ নাটোর সিপিসি-২ এর ক্যাম্প কমান্ডার রাজিবুল আহসান ও এস এম জামিল আহমেদের নেতৃত্বে র্যাব সদস্যরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে টহল দেয়।
টাঙ্গাইল : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টাঙ্গাইল সদর থানা পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে। মাইকিং করে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ ছাড়াও র্যাবের পক্ষ থেকে শহরে হাতধোয়া কর্মসূচি ও মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা হয়।
সিরাজগঞ্জ : ‘বাড়িতে থাকুন-করোনা প্রতিরোধ করুন’ স্লেøাগান নিয়ে সিরাজগঞ্জে র্যাব-১২ সদস্যরা সচেতনামূলক মোটরসাইকেল ও গাড়ি র্যালি করেছে। সকাল থেকে হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের প্রতিটি রাস্তায় র্যালিটি প্রদক্ষিণ করে। এ সময় র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নেমে সাধারণ মানুষকে বাড়িতে থাকুন এবং করোনা প্রতিরোধ করুন সম্পর্কে জনসচেতনতা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেন।
এ ছাড়া নাটোরে করোনাভাইরাস নিয়ে জনসচেতনতায় মাঠে নেমেছে র্যাব-৫ এর সদস্যরা। র্যাব সদস্যরা শহর ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণের পাশাপাশি মাইকে সবাইকে করোনা সংক্রমণ রোধে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দেন। কিশোরগঞ্জে করোনা বিষয়ে ১২টি নির্দেশনা নিয়ে প্রচারণার অংশ হিসেবে র্যাব র্যালি করেছে। এ সময় ‘বাড়িতে থাকুন’ লেখা সংবলিত ফেস্টুন বহন করেন র্যাব সদস্যরা। ফরিদপুরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশের পক্ষেও প্রচারণা চালানো হয়েছে। ময়মনসিংহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে পঞ্চম দিনেও প্রচারণা চালিয়েছেন পুলিশ সুপার ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কিশোরগঞ্জে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সেনাবাহিনী সচেতনতামূলক মহড়া দিয়েছে। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে গতকাল দিনব্যাপী সদরের বিভিন্ন এলাকায় এ মহড়া চলে। তারা বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইন মানা, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া ইত্যাদি বক্তব্য হ্যান্ডমাইকে প্রচার করেন। যশোর সেনানিবাসের ৮৮ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ কবীর বলেছে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে প্রয়োজনে যশোর সেনানিবাসের পাশে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। আর সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে শিগগিরই মাঠে নামছে সেনা মেডিকেল টিম। শেরপুরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে শেরপুরে জনসচেতনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হয়েছে। সবাইকে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে বলা হচ্ছে এই মাইকিং থেকে। সেনাবাহিনীও বিভিন্ন স্থানে প্রচারণা চালিয়েছে। সিলেটে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সিলেট বিভাগ চষে বেড়াচ্ছে সেনাবাহিনীর ২০টি টিম। সিলেট বিভাগজুড়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি, হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রবাসীদের পর্যবেক্ষণ, বাজার মনিটরিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় মানুষের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি ও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক থাকায় স্বস্তি ফিরেছে জনমনে।