বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশে প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু

আকুতি ছিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের, পাননি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সও, প্রশ্ন সিলেটের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

দেশে প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু

একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক তিনি। আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগী দেখতেন। গ্রামের বাড়িতে সপ্তাহে এক দিন বিনা মূল্যে তিনি চিকিৎসাসেবা দিতেন। চিকিৎসক হিসেবে প্রতিদিন শত শত মানুষকে দিয়েছেন সেবা। তার চিকিৎসাসেবায় সুস্থ হয়েছেন অগণিত মানুষ। ‘মানবিক ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া মঈন উদ্দিন নিজে যখন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন, তখন তার সামনে হাজির হলো অবিশ্বাস্য এক বাস্তবতা। আক্রান্ত হওয়ার পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রবল আকুতি ছিল তার। কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দূরে থাক, সরকারের পক্ষ থেকে একটি ‘আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সও’ কপালে জোটেনি মঈনের! শেষ পর্যন্ত রূঢ় বাস্তবতায় আফসোসকে সঙ্গী করে চিরবিদায় নিয়েছেন ডা. মঈন উদ্দিন। দেশে করোনায় আক্তান্ত হয়ে মৃত্যুর শিকার প্রথম চিকিৎসক তিনি।

সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের এই সহকারী অধ্যাপক গতকাল বুধবার ভোর সাড়ে ৪টায় ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক তিনি। তাকে করোনাযুদ্ধে প্রথম ‘শহীদ’ হিসেবেও মন্তব্য করছেন অনেকে। তার মৃত্যুতে শোকাতুর সিলেটের চিকিৎসাঙ্গন। অ্যাম্বুলেন্সযোগে গতকালই তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের নাদামপুর গ্রামে নিয়ে দাফন করা হয়েছে। ডা. মঈনের স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। এই দম্পতির এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে। মরণব্যাধি করোনা বাংলাদেশে ছোবল হানার পর অনেক চিকিৎসকই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বন্ধ করে দেন রোগী দেখা। কিন্তু এই কঠিন সময়েও ‘স্বার্থপরতা’ আটকে রাখতে পারেনি ডা. মঈনকে। নিজের সরকারি কর্মস্থল ছাড়াও সিলেট নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ করেননি তিনি। সেবার ব্রত নিয়ে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া মঈন হঠাৎ করেই শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করেন। জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগতে শুরু করায় নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে কোয়ারেন্টিনে থাকা শুরু করেন। এর মধ্যে তার শরীরের প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় ঢাকায় আইইডিসিআরে। গেল ৫ এপ্রিল আইইডিসিআর জানায়, ডা. মঈন করোনা পজিটিভ। সিলেটে এটিই করোনাক্রান্ত রোগী শনাক্তের প্রথম ঘটনা। করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই নগরীর হাউজিং এস্টেটের বাসায় ডা. মঈনকে আইসোলেশনে রাখা হয়। ৭ এপ্রিল শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ওই দিন রাতেই নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। জানা গেছে, ওই সময় ডা. মঈন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে দ্রুত ঢাকায় গিয়ে ভেন্টিলেশনসহ করোনার পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা আছে এমন হাসপাতালে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের বেডে থেকে নানা মহলে চেষ্টা করেও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাননি তিনি। তার সরকারি কর্মস্থলও এ ক্ষেত্রে তাকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ আছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন মঈন। সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হলেও এখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি ও তার চিকিৎসক স্ত্রী। ফলে দ্রুত ঢাকার কোনো হাসপাতালে যেতে উদগ্রীব ছিলেন মঈন। কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বিলম্বিত হয় তার ঢাকাযাত্রা। এরপর আইসিইউ সুবিধাযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ করেন তিনি। কিন্তু সরকারি কোনো অ্যাম্বুলেন্স মেলেনি। পরে ৮ এপ্রিল বিকালে এক সহকর্মীর চেষ্টায় বেসরকারি একটি হাসপাতালের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় গিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন ডা. মঈন। ঢাকার কোনো হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ডা. মঈনের ছটফটানি সিলেটে করোনার চিকিৎসাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। ডা. মঈন সরকারি চিকিৎসক। তিনি সিলেটে করোনা চিকিৎসার বাস্তব চিত্র জানেন। এ জন্যই তিনি দ্রুত ঢাকায় যেতে উদগ্রীব ছিলেন- এমন দাবি উঠতে থাকে সচেতন মহল থেকে। সিলেটে করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভেন্টিলেটরযুক্ত দুটি আইসিইউ আছে বলে দাবি করা হলেও এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় সংশয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ হাসপাতালে আইসিইউর জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি দক্ষ লোকবলেরও অভাব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ হাসপাতালের নিয়ন্ত্রক ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান ও উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় সংবাদ সম্মেলন করে জানান, করোনা চিকিৎসার জন্য সিলেট প্রস্তুত আছে। ডা. মঈন উদ্দিন নিজের সিদ্ধান্তেই ঢাকায় গেছেন। তবে ডা. মঈন ঢাকায় যাওয়ার পরই শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ৯টি ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেড বরাদ্দ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এদিকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে শুরুতে ডা. মঈন উদ্দিনের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সোমবার অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানেই গতকাল সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক লে. কর্নেল এ বি এম বেলায়েত হোসেন সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘তিন দিন ধরে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। রেসপিরেটরি ফেইলিওরের কারণে তার মৃত্যু হয়।’ ডা. মঈনকে করোনাযুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে প্রথম ‘শহীদ’ বলে অভিহিত করছেন তার সহকর্মীরা। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে ক্ষোভও আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডা. মঈনের এক সহকর্মী বলেন, ‘৭ এপ্রিল যদি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পেতেন, তবে দ্রুতই ডা. মঈন উদ্দিন ঢাকায় যেতে পারতেন। সেখানে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে তার বেঁচে থাকার একটা সুযোগও হয়তো থাকত।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. মঈন উদ্দিন সিলেটজুড়ে ‘মানবিক ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত। নিজের চেম্বারে অসহায়-গরিব রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতেন না তিনি। এমনকি নিজের গ্রামের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার বিনা মূল্যে সব শ্রেণির মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন মঈন। তার গ্রামের বাড়ি সূত্রে জানা গেছে, মঈনের বাবা একজন পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি ছেলেকে অসহায় মানুষদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। বাবার নির্দেশ আমৃত্যুই মেনে চলেছেন ডা. মঈন। ফলে তার মৃত্যু এলাকার লোকজনকে অনেক বেশি শোকে মুহ্যমান করছে। মঈনের গ্রাম ছাতকের নাদামপুরের বাসিন্দা গিরিধর দাস বলেন, ‘একজন অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ডাক্তার ছিলেন মঈন উদ্দিন। অসহায়, দরিদ্রদের বিনা মূল্যে সেবা দিয়েছেন। তার মৃত্যুতে মানুষ কাঁদছে।’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল জানান, মঈনের পরিবারের চাওয়া অনুযায়ী তার মরদেহ সংক্রামক বিধির সব নিয়ম মেনে তার গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর