রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

মানুষের পাশে নেই ওরা

বিদেশে অর্থ পাচারকারী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও ট্রাস্টি, এনজিও, প্রভাবশালী মেয়র এমপিসহ অনেক জনপ্রতিনিধি, মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ অনেক বিত্তশালী

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানুষের পাশে নেই ওরা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত দেশ। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ একেবারে নাকাল। দুর্যোগের এই কঠিন সময়ে দেশের নামিদামি এনজিও, প্রভাবশালী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও ট্রাস্টি, বিদেশে অর্থ পাচারকারী হিসেবে খ্যাত বিত্তশালীরা, ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর কোনো মানবিক উদ্যোগ নেই। এদের মতোই মাঠে নেই অনেক জনপ্রতিনিধি। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়র ফজলে নূর তাপসের কোনো সাড়াশব্দই গত দুই মাসে দেখতে পাননি নগরবাসী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামেরও তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সরকারি ও বিরোধী দলের প্রভাবশালী অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও চলে গেছেন লকডাউনে। সাহায্যের আশায় থাকা অসহায় মানুষের ফোনও ধরছেন না অনেক সংসদ সদস্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। জানা গেছে, এই দুঃসময়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা বলছেন তারা চাইলেই দান-অনুদান দিতে পারেন না। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নামিদামি ও প্রভাবশালী ট্রাস্টি জমি কেনার নামে অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। কায়দা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ নিয়ে নেন নিজেদের পকেটে। অথচ দেশের এই সংকটের সময় তাদের কোনো মানবিক ভূমিকা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আইন সংশোধন করে ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের দান-অনুদানের বিধি নির্দিষ্টকরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সংকটের এই সময়ে গরিব মানুষের কল্যাণে মাঠে কোনো তৎপরতাই নেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও)। শুধু ব্র্যাক রয়েছে মাঠে। ছোট-বড় আর কোনো এনজিওকেই দেখা যাচ্ছে না। ব্র্যাক শুরু থেকেই এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। দেশে বহু এনজিও রয়েছে। যাদের আর্থিক অবস্থাও খুব ভালো। কিন্তু মানবতার সেবায় নিজেদের না লাগিয়ে যেন হাত গুটিয়ে ঘরে বসে আছে। অসহায় গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।

একই অবস্থা মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর। দেশে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি থাকলেও কোথাও তাদের কোনো তৎপরতা নেই। যা খুবই হতাশাজনক। গ্রামীণফোনসহ সব মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির কাছেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল এই দুঃসময়ে তারা মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি থেকেই কোনোরকম তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তারা যেমন মাঠে নেই, তেমনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও তাদের অনুদান দিতে দেখা যায়নি।

অনেক বিত্তশালী ব্যবসায়ী রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও এখন পর্যন্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

এনজিও, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থ পাচারকারী, বড় বড় বিত্তশালী, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিরগুলোর মতোই দেশের মানুষের এই দুর্দিনে পাশে নেই অনেক জনপ্রতিনিধি। যার মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র এমনকি অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও রয়েছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই প্রতিনিধির বেশির ভাগই মাঠে অনুপস্থিত। সবাই যেন সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে নিজেদের লকডাউন করে রেখেছেন। সাহায্য পাওয়া বা পাশে পাওয়া দূরের কথা, মানুষ তাদের ফোন করেও পাচ্ছে না।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দেশে অনেকে কোটিপতি হচ্ছেন কোনো পরিশ্রম না করেই। অনিয়ম, দুর্নীতি করে ভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করছেন তারা। এভাবে কোটিপতি, বিত্তশালীরা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, ‘এদের মধ্যে মানবিকতার অভাব রয়েছে। তাদের মধ্যে মানবিকতাবোধ গড়ে ওঠেনি, মানবিক গুণগুলো বিকশিত হয়নি। তাই অন্যদের প্রতি সহানুভূতি নেই তথাকথিত এই বিত্তবানদের।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর দরকার আছে, ত্রাণ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এনজিওরা ছোট ছোট ক্ষেত্রে কাজ করে। করোনার সময়ে কিছু কাজ করলেও বেশির ভাগ এনজিও ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ধনী হিসেবেও এ পরিস্থিতিতে সেভাবে এগিয়ে আসছেন না। মানুষের উপকারে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। তাদের করার অনেক রয়েছে এ দেশের মানুষের জন্য, যা অনেকে করছেন না।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু লোক দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, আমি এক কথায় বলব, তারা লুটেরা। এদের দেশের বা দেশের মানুষের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই, মানবতাবোধ নেই। দেশের এই দুর্যোগকালে তাদের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। এই লুটেরা লোকগুলো জাতির শত্রু, মানবতার শত্রু, বিশ্বের শত্রু। তারা কারও বন্ধু নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সময় এসেছে এসব লুটেরার কালো টাকাগুলো খুঁজে বের করে সাধারণ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার। এতে অসহায় মানুষের কষ্ট কিছুটা কমবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে যেসব অসৎ অতি ধনী, ধনী শ্রেণির মানুষ দেশের পাশে দাঁড়ায়নি মনে হয় তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিংবা দেশে থাকলেও গা-ঢাকা দিয়েছে। সরকারের উচিত হবে এদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া। এখানে দুই ধরনের ধনী রয়েছে- যারা নাকি সৎ কিংবা যাদের কোনো বদনাম নেই তারা কিন্তু সরকারের তথা দেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেমন বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরও অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ আছে এ তালিকায়। আর যারা অসৎ উপায়ে ধনী হয়েছেন তারা মনে হয় সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে রয়েছে। অথচ পাড়া-মহল্লায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নানাভাবে চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও গ্রুপ গ্রুপ করে ৫০ জন ১০০ জনকে সহায়তা করছে। এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু যাদের সামর্থ্য বেশি তাদের বেশির ভাগই এখন সরকারের পাশে নেই। দেশের পাশে নেই। তবে এটা কিন্তু একটা সুযোগও সরকারের জন্য, আপনার জন্য, আমার জন্য, সবার জন্য। কারণ আমরা চিনতে পারছি আসলে কারা দেশপ্রেমিক আর কারা স্বার্থপর।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর