রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগ সাহসের সঙ্গেই মোকাবিলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগ সাহসের সঙ্গেই মোকাবিলা

সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ঝড়ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ আসবেই। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাহসের সঙ্গে আমাদের এসব মোকাবিলা করতে হবে।

গতকাল বিকালে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত শোক প্রস্তাব এবং অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ইতিহাসে বিরল মাত্র সোয়া ঘণ্টা ছিল এ অধিবেশনের স্থায়িত্ব। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই করোনা সংকট ঠিক কত দিন চলবে তা বিশ্বের কারোর জানা নেই। বিশ্বের অনেকেই করোনার কারণে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশে যাতে দুর্ভিক্ষ না হয়, সেজন্য এরই মধ্যে আমরা তিন বছর মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করছি। তিনি বলেন, আমাদের দেশে খাদ্যের কোনো অভাব নেই। এই সংকটকালে মানুষের জীবন যাতে চলে এবং সবাই সুরক্ষিত থাকে সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। দেশের একজন মানুষও যেন খাদ্যের অভাবে কষ্ট না পায়, সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দেশের ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ের সংসদ অধিবেশনের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে গতকাল বিকাল ৫টার পর অধিবেশন শুরু হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় শেষ হওয়া এ অধিবেশনে প্রধান ইস্যু ছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণের সতর্কতা। কোরাম পূর্ণ হওয়ার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন ৬০ জন বা তার সামান্য কিছু বেশি সদস্য সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকবেন বলে পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল। তবে অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন ১২২ জন সংসদ সদস্য।

সংসদ কক্ষে আইনপ্রণেতাদের আসনের মাঝে দূরত্বও দেখা গেছে। এজন্য সিনিয়র সংসদ সদস্য এবং ঢাকার বাইরে অবস্থানকারী সংসদ সদস্যদের উপস্থিত হতে আগেই নিরুৎসাহিত করা হয়। সংসদে প্রবেশের সময় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্টদের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। গণমাধ্যমকর্মীদের সংসদ ভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অধিবেশনে অংশ নেওয়া প্রধানমন্ত্রীসহ সব সদস্যই মাস্ক-গ্লাভস পরে ছিলেন। অনেকের মাথায় সার্জিক্যাল টুপিও দেখা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্পিকার শোক প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। চলতি সংসদের সদস্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুসহ করোনাভাইরাসে নিহত সবার রুহের মাগফিরাত কামনা করে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন এবং পরে মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাত পরিচালনা করেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া। সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, মো. শাজাহান খান, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। সংসদে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সরকারি কর্ম কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন উত্থাপন করেন। শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পরই স্পিকার সংসদ অধিবেশন সমাপনীর বিষয়টি সংসদকে অবহিত করেন। সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সবাই স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনাগুলো মেনে চলুন। অযথা বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। নিজেরা সুরক্ষিত থাকুন, অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখুন। অন্যদের জীবন যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে। তিনি বলেন, ১০ টাকা কেজি দরে চালের জন্য ৫০ লাখ রেশন কার্ড দেওয়া হচ্ছে। আরও ৫০ লাখ রেশন কার্ড প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছি। এতে একটি পরিবারে পাঁচজন সদস্য থাকলেও সে হিসেবে এ রেশন কার্ডের মাধ্যমে দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ সুবিধা পাবে। দেশ যেন দ্রুত এ সংকট থেকে মুক্তি পায়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে সেজন্য দেশের মানুষকে আল্লাহর দরবারে দোয়া ও প্রার্থনার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কেউ যেন খাবারে কষ্ট না পায় সেজন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সময় আমি নিজেও এসএমএস পাই, ‘আপা আমার ঘরে খাবার নাই’। সঙ্গে সঙ্গে আমরা উদ্যোগ নিই। শুধু তার (ওই মেসেজদাতা) নয়, আশপাশে কোথায় কারা এভাবে কষ্টে আছে, যারা হাত পাততে পারবে না, কিন্তু তাদের ঘরে খাবার নেই, চাইতে পারছে না- তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার সেই ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি এবং নিচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের চিকিৎসার সব খরচ সরকারিভাবে বহন করা হচ্ছে। যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তাদের কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেওয়া হয় না। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ব্যবস্থাপনা আমরা নিচ্ছি। আমরা প্রতিটি জায়গায় বিশেষ করে স্থলবন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দরসহ সব জায়গায় করোনা পরীক্ষার জন্য থারমাল স্ক্যানার ও ইনফারেড থারমোমিটারের মাধ্যমে স্কিনিং করা শুরু করেছি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সব সেক্টরকে অন্তর্ভুক্ত করে একটা জাতীয় কমিটি করে দিয়েছি। করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউকেএইড, ইউএসএইডসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে।

করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী তিন বছরের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা এবং ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কত দিন এ অবস্থা চলবে, বিশ্বের কেউই তা বলতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ যাতে কষ্ট না পায়, দেশের অর্থনীতি যাতে গতিশীল ও প্রাণসঞ্চার হয় এবং অর্থনীতির নেতিবাচক দিকগুলো যাতে মোকাবিলা করতে পারি সেজন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। বড় শিল্প থেকে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প, গার্মেন্ট, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ, দিনমজুর সবার কথা বিবেচনা করে এসব প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষ যেন খাদ্যে কষ্ট না পায়, যারা হাত পাততে পারে না তাদের খুঁজে বের করে ঘরে খাদ্যসহ অন্যান্য সহযোগিতা পৌঁছে দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একখ- জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। মাত্র শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষিঋণ দেওয়া হচ্ছে। সার-বীজসহ সবকিছু সরবরাহ করা হচ্ছে। যারা দিনমজুর তারা যেন ধান কাটতে যেতে পারেন সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকসহ সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, বিশেষ করে ছাত্ররাও দেশের এ সংকটকালে ধান কাটার কাজে সহযোগিতা করতে পারে। আমরা যদি ধানগুলো কেটে সঠিকভাবে ঘরে তুলতে পারি তবে দেশে কোনো খাদ্য সংকট হবে না। সবাই যে যেভাবে পারেন কিছু ফসল উৎপাদন করুন, যাতে আমাদের খাদ্য সংকট না হয়। বরং অন্য দেশকে আমরা এ সময় সহযোগিতা দিতে পারি। বারবার সতর্ক করার পরও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশের মানুষ একটু বেশিই সাহসী হয়ে গেছে। এ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। অথচ অনেকে ঘরে না থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন, অনেকে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেসব জায়গাকে সংক্রমিত করছেন। আমরা ঘরে থাকতে অনুরোধ করছি, কিন্তু দেখছি অনেকে অযথাই বাইরে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, গল্প করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতেই চাইছে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক। তাই সবার প্রতি অনুরোধ- যে যেখান আছেন, সেখানেই থাকুন। ঘরে থাকলে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করতে পারবে না। একজন মানুষ থেকে যতটা দূরত্ব রাখতে পারবেন, ততই ভালো। কারণ শুধু নিজে নয়, সবাইকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। করোনার নমুনা সংগ্রহে কিটের কোনো সংকট নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত আমরা ৯২ হাজার পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করেছি। তার মধ্য থেকে ২০ হাজার কিট বিতরণ করা হয়েছে এবং ৭২ হাজারের মতো কিট এখনো মজুদ রয়েছে। কিট সংগ্রহ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কাজেই করোনা পরীক্ষায় কিটের কোনো অভাব হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। আর প্রতি জেলার হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ স্থাপনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ দিবসের কর্মসূচি স্থগিতের কথা উল্লেখ করে বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে সংসদে বিশেষ একটি অধিবেশন বসার কথা ছিল। মুজিববর্ষ পালনের জন্য বিশাল প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। কারণ একমাত্র আমরা দুই বোন ছাড়া ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছি। তাই মুজিববর্ষ পালনের সুযোগটা ছিল আমাদের জন্য সত্যিই বিরল। কিন্তু সারা বিশ্বে দেখা দেওয়া করোনার কারণে সব কর্মসূচি আমাদের বন্ধ করতে হয়েছে। কারণ দেশের মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা। সেজন্য সব কর্মসূচি আমরা স্থগিত করে রেডিও-টেলিভিশনসহ ডিজিটাল মাধ্যমে সামান্যভাবে পালন করেছি। করোনাভাইরাসে মৃত সবার রুহের মাগফিরাত কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিসেম্বরে এ রোগটা চীনে প্রথম দেখা দেওয়ার পর থেকেই আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করি। অতীতে আমরা অনেক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি। কিন্তু এ ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী এমন ঝড় উঠবে তা কল্পনারও অতীত ছিল। আর এ ভাইরাস মোকাবিলার অতীত কোনো অভিজ্ঞতাও আমাদের ছিল না। তবু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা এবং আমাদের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আমরা ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

সর্বশেষ খবর