বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা চিকিৎসা নিয়ে টানাটানি

হাসপাতালে বেহাল দশা, পা পিছলে মাথা ফাটে রোগীর, ক্লিনার নেই, পানির জন্য সিঁড়ি ভাঙতে হয় কয়েক তলা, সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই হাসপাতালে, ভেন্টিলেশনের কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা

মাহবুব মমতাজী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় বেহালদশা। রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনা পজিটিভ রোগী গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় এক কক্ষে। আরেক রোগী পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হলেও এগিয়ে আসেননি কেউ। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ভেনটিলেটরের ব্যবস্থা নেই করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয়। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর টানাটানিতে সারা দিনে একবার চিকিৎসক-নার্সদের দেখা পান মুমূর্ষু রোগীরা। কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি এক রোগী বলেন, ‘হাসপাতালের তিন তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত ওয়ার্ডে করোনা আক্রান্তদের রাখা হয়েছে। ওয়ার্ডগুলোয় তালা মেরে রাখা হয়। তিন বেলা খাবার দিলে মাইকিং করে বলা হয়। তখন আমাদের শ্বাসকষ্ট থাকুক আর যত সমস্যাই হোক ওয়ার্ডের দরজা থেকে নিজেদের নাম লেখা বক্সে খাবার ও ওষুধ নিয়ে আসতে হয়। ওষুধ নিজ দায়িত্বেই খেতে হয়। চিকিৎসক-নার্সরা এক থেকে দুবার আসেন।’ এর আগে এ হাসপাতালের টয়লেটের দরজায় এক রোগীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি কখন টয়লেটে গিয়ে পড়ে গেছেন তা জানেন না কেউ। মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তাকে টয়লেটের সামনে দেখতে পেয়ে অন্য রোগীরা হাসপাতালের কর্মীদের জানান। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের এক রোগী জানান, হাসপাতালে আসার পর একটা ঘরে সবাইকে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে পানির তৃষ্ণা পেলেও নেই কোনো ব্যবস্থা। এমনকি ঘরের আশপাশে কোনো টয়লেটেরও ব্যবস্থা নেই। তীব্র অসুস্থতা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় রোগীদের। মুগদা হাসপাতালের আরেক রোগী বলেন, ‘আমার পাশের বেডে ৯০ বছর বয়সী এক রোগী করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিছানা থেকে মেঝেয় পড়ে যান। এতে মাথায় আঘাত লেগে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। অনেক পরে ডাক্তার এসে চিকিৎসা দিয়েছেন। রোগীদের সমস্যায় নার্স-ওয়ার্ডবয়দের ডাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি এক রোগী বলেন, ‘আমি হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ওয়ার্ডে আছি। ওয়ার্ডগুলোয় রোগীদের পানি খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের এক তলা নেমে পানি আনতে হচ্ছে। টয়লেট খুবই নোংরা। রোগী পিছলে পড়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই। টয়লেটের বাইরে হাত ধোয়ার জন্য সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশের কোনো ব্যবস্থা নেই। অসুস্থ শরীরে এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে আমাদের। নেই জরুরি সামগ্রীও।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স করোনা আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দিনে সাধারণত একবার চিকিৎসকরা দেখে যান। তখন সঙ্গে নার্সেরাও আসেন। চিকিৎসকরা চলে যাওয়ার পর নার্সেরাও আর কখনো আসেন না। এমনকি জরুরি অবস্থায় ওয়ার্ডবয়দের ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। রোগীকে প্রয়োজনে নিচে যেতে হয়। টয়লেটের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তিন দিনেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা আসেন না এ হাসপাতালে।’

মুগদা হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স জানান, মুগদা হাসপাতাল করোনা হাসপাতাল হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর অনেক পরিচ্ছন্নতা কর্মী পালিয়ে গেছেন। এজন্য বিপাকে পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কুর্মিটোলা হাসপাতালে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসকরা একবার অথবা দুবার রাউন্ডে যান। এ সময় নার্সেরাও সঙ্গে থাকেন। রোগী দেখতে গেলে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) পরতে হয়। এতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগে। একবার রোগী দেখে এসে পিপিই পাল্টে ফেলতে হয়। তাই চাইলেও বারবার পিপিই পরে যাওয়া যায় না। এত বেশি পিপিই পাল্টালে এসব সামগ্রীর সংকট দেখা দেবে। তবে নার্সেরা প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকেন বলে আমরা জানি।’

ভেনটিলেটরের কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা : কভিড-১৯ রোগীদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাদের কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে ভেনন্টলেটরের প্রয়োজন হয়। এ মুহূর্তে বিভিন্ন হাসপাতালে ঠিক কয়টি ভেনটিলেটর আছে তা নিয়ে আলোচনা থাকলেও এ যন্ত্রটি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে রোগীকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয়। মাত্র দুটি হাসপাতালে সীমিত আকারে রাখা হয়েছে সেন্ট্রাল স্টোরেজ ব্যবস্থা। রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং বেসরকারি তিনটি হাসপাতালের মধ্যে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল এবং মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত সাজিদা ফাউন্ডেশনের হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ তৈরি করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৮ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত নয়জন রোগী মারা যান। এর আটজনকেই ভেনটিলেটর দেওয়া ছিল। এর পরও কেন তারা শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন, তার তদন্ত চেয়েছিলেন করোনা চিকিৎসায় গঠিত বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্সের সদস্যরা। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর সেটিকে গুরুত্বে নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। করোনার নির্ধারিত হাসপাতালের বেশির ভাগই রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় সিলিন্ডার থেকে। মাত্র দুটি হাসপাতাল- কুয়েত-মৈত্রী আর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সীমিত আকারে রয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন স্টোরেজ সিস্টেম। যেখান থেকে নির্ধারিত লাইনের মাধ্যমে আইসিইউতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মুজাহারুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড-১৯-এর কোনো চিকিৎসা নেই। এ রোগ যখন কারও শ্বাসযন্ত্রে আক্রান্ত হয়, তখন রোগীদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখতে সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। আবার নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখতে সেন্ট্রাল স্টোরেজ থেকে ভেনটিলেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। যদি করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় সেন্ট্রাল স্টোরেজ না থাকে তাহলে ভেনটিলেটরের কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এটা থাকা না থাকার মতোই। তাই দ্রুত এটি প্রতিস্থাপনের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা খুব দ্রুতই স্থাপন করা যায়।’

জানা গেছে, একটি ভেনটিলেটরের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হলে ৫০ পিএসআই প্রেসার প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় ব্যবহৃত ১০টি সিলিন্ডার একত্র করলে পাওয়া সম্ভব। তবে তাও মাত্র প্রথম ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। এরপর আর ভেনটিলেটরে অক্সিজেন আসবে না।

কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা রোগীর সবচেয়ে বেশি সমস্যা শ্বাসকষ্টে। এসব রোগীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। রোগীকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর করা যাবে না। সিলিন্ডার দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা যায় না এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী করোনা রোগীর ভেনটিলেশনে অক্সিজেনের যে প্রেসার দরকার তা এ সিলিন্ডার থেকে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া একজন সাধারণ মানুষ প্রতিদিন গড়ে ১১ থেকে ১২ হাজার লিটার অক্সিজেন শ্বাস-প্রশ্বাসে গ্রহণ করে। তবে করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন ব্যবহারের হার বেড়ে যায়। একটা সাধারণ সিলিন্ডার থেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অক্সিজেনের সরবরাহ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদিত একমাত্র অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে লিন্ডে বাংলাদেশ। এই প্রতিষ্ঠানসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত সিলিন্ডারে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ লিটার অক্সিজেন ধরে যা মূলত রোগীদের সাময়িকভাবে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার হয়। আর করোনা আক্রান্ত রোগীদের কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য এ ধরনের সিলিন্ডার কোনো কাজে আসবে না। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন স্টোরেজ সিস্টেম ছাড়া ভেনটিলেটর কোনো কাজে লাগবে না। যেসব হাসপাতালের সেন্ট্রাল স্টোরেজ সিস্টেম থেকে ভেনটিলেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, সেখানেই শুধু করোনা রোগীর জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে এ সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) আমিনুল হাসান এই প্রতিবেদকদের জানান, করোনার জন্য নির্ধারিত কুয়েত মৈত্রী আর কুর্মিটোলায় সীমিত আকারে সেন্ট্রাল স্টোরেজ আছে। এটা শুধু আইসিইউর জন্যই রয়েছে। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, স্কয়ার, এ্যাপোলো, আনোয়ার খান মডার্নসহ বেশ কিছু হাসপাতালে এ সুবিধাটি রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, এ মুহূর্তে বিভিন্ন হাসপাতালে ভেনটিলেটরের সংখ্যা ১৯২। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোয় ৫০০ ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ৭০০ ভেনটিলেটর রয়েছে। আর ৩০০ ভেনটিলেটর পাইপলাইনে আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর