মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছে রোগী

ভয় ও আতঙ্কের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া, নেই মানসিক সাহস জোগানোর কেউ

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বেশ কিছু রোগী সম্প্রতি হাসপাতালে অবস্থান করে চিকিৎসা না নিয়ে উল্টো পালিয়ে যান। আতঙ্কজনক এই ঘটনায় একদিকে এসব রোগীর যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে তাদের মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমণ ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত মনস্তাত্ত্বিক কারণেই রোগীরা এমন করছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের পাশাপাশি মৃত্যুভয়ও কাজ করছে। তাদের অনেকেই করোনা চিকিৎসার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। এ ছাড়া হাসপাতালে অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা, চিকিৎসক/নার্সদের সেবা এবং খাবারসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় রোগীরা হাসপাতাল থেকে কাউকে না জানিয়েই চলে যাচ্ছেন বা পালিয়ে যাচ্ছেন। আবার অসহায়ত্ব ও নিঃসঙ্গতাবোধ থেকেও কিছু রোগী পালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো অবস্থাতেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া উচিত নয়। বরং হাসপাতালে থাকলে তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। আর পালিয়ে গেলে রোগ কমবে না উল্টো অন্যের মাঝে সংক্রমণ ঘটবে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি রোগীদের কাছে একেবারেই নতুন। ফলে কেউই তার করণীয় বুঝে উঠতে পারছে না। আর পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে অনেকেরই মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। অথচ এই রোগীদের মানসিকভাবে সাহস জোগানোরও কেউ নেই। সম্প্রতি সরকার নির্ধারিত করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীরা হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনার তথ্য তুলে ধরেছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ দিন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ইনডিপেনডেট টেলিভিশনের ভিডিওগ্রাফার আশিকুর রহমান রাজু। সেখানকার চিকিৎসাব্যবস্থার বর্ণনা করে তিনি জানান, হাসপাতালে যাওয়ার পর সবাই দূরে দূরে ছিলেন। হাসপাতালে বিকাল ৩টায় গেলেও তাকে চিকিৎসকরা দেখতে আসেন রাত ৯টায়। এ ছাড়া সেখানে রোগীদের সময়মতো খাবার দেওয়া হতো না। যে খাবার দেওয়া হতো তার মানও ভালো ছিল না। রোগীদের নিজেকেই ওষুধ ও খাবার ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না পেয়ে রোগীরা নানা অভিযোগ করছেন। আমার কাছে অনেক রোগী এসে অভিযোগ করেছেন, হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা এতই খারাপ যে এর থেকে বাসায় বসে চিকিৎসা নেওয়া অনেক ভালো। রোগীরা আরও অভিযোগ করেছেন, হাসপাতালে যেমন কাক্সিক্ষত সেবা নেই তেমন নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স। ধারণা করা যেতে পারে যে, মনস্তাত্ত্বিক কারণেই অনেক করোনা রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন।

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন এক নারী। সম্প্রতি তিনি একটি মৃত শিশুর জন্ম দেন। হাসপাতালে থাকাকালে এই নারীর শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। পরে নমুুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরদিন তার করোনা পজিটিভের খবর এলেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া করোনা উপসর্গের তথ্য গোপন করে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ৫০ বছর বয়সী এক রোগী ভর্তি হন।

 চিকিৎসকরা তার শরীরে করোনার উপসর্গ দেখে নমুনা সংগ্রহ করে করোনা পরীক্ষার জন্য পাঠান। সেই ব্যক্তির করোনা পজিটিভ আসে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে আইসোলেশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে সেই রোগীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকটি হাসপাতালে ভর্তির সময় যে ঠিকানা দেন সেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে খিলক্ষেত থানা থেকে ওই ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য চট্টগ্রাম চান্দগাঁও থানায় পাঠানো হয়। পরে পুলিশ প্রযুক্তির সহযোগিতায় সেদিন রাতেই ফেনী সদর থানার সহায়তায় লোকটিকে আটক করে। সে রাতেই আটক ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশনে পাঠানো হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালে যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্বে আছেন তাদের কাছ থেকেও কোনো সহযোগিতা না পেয়ে রোগীরা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই অসহায়ত্ব ও নিঃসঙ্গ বোধ করেন। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই হাসপাতাল থেকে নিখোঁজ হয়ে যান তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর