বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

হাসপাতালে যেতে চায় না কেউ

ঢাকা মেডিকেল ও মুগদা মেডিকেলে নষ্ট পিসিআর মেশিন

মাহমুদ আজহার

কভিড-১৯ আক্রান্ত কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে এখন আর পারতপক্ষে কেউ হাসপাতালে যেতে চায় না। হাসপাতালে নানা ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে করোনা রোগীর একটি বড় অংশ। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স না আসা, নোংরা ওয়াশরুম, ওয়ার্ড তালাবদ্ধ করে রাখায় তৈরি হচ্ছে বিভীষিকা। আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তি ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকছে এক রুমের মধ্যে। হাসপাতালের এ পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে রোগীরা। রোগীর চাপ সামলাতে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়ায় উৎসাহিত করছেন চিকিৎসকরাও।

ভুক্তভোগী রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালেই পদে পদে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অনেকেই হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বড় ধরনের তদবির ছাড়া সাধারণ মানুষের ভর্তি হওয়ার সুযোগও কম। হাসপাতালের পরিবেশও ভালো নয়। এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালবিমুখ হয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস আক্রান্তরা। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করেই বাসা থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে কেউ কেউ।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার পিসিআর মেশিন নষ্ট থাকায় রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। জানা গেছে, এসব মেশিনে সবারই করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। এ কারণে এসব মেশিনে করোনা পরীক্ষা আপাতত বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় হাসপাতালের ল্যাব থেকে করাচ্ছে এই হাসপাতালগুলো। চাপ বাড়ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোগীরা হাসপাতালে যাবেন, চিকিৎসা নেবেন এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যত্যয় হওয়া ঠিক নয়। সরকার বলছে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে। তাহলে চিকিৎসাসেবা দিতে পিছপা হওয়া যাবে না। তবে আমাদের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে ফিরে যান। তা ছাড়া করোনার উপসর্গ না থাকলে বা জটিল পর্যায়ে না গেলে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেওয়া যায়।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার ও তার মেয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। বাসায় থেকেই তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেন। করোনায় আক্রান্ত বিটিভির মহাপরিচালক হারুন অর রশীদসহ তার পরিবারের সদস্যরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক, আমলা, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ অনেকেই বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরাও জটিল কোনো পরিস্থিতি না হলে বাসায় থেকেই চিকিৎসাসেবা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মী প্রতিদিনের সংবাদ-এর সিনিয়র রিপোর্টার গাজী শাহনেওয়াজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল রাতে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি আগের চেয়ে এখন অনেকটাই সুস্থ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করছি। গতকাল নমুনা আরেক দফা নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছি। এখনো রেজাল্ট পাইনি। আশা করি ভালো ফল পাব।’ এদিকে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় মারা যান অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্নসহ রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। অন্য কোনো হাসপাতাল না পেয়ে শেষে গত বৃহস্পতিবার করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এই সরকারি কর্মকর্তাকে। গত শনিবার তিনি মারা যান। এর আগে ১৯ এপ্রিল রাজধানীর ১১টি হাসপাতালে স্বামীকে নিয়ে ঘোরেন মিনু বেগম। কোনো হাসপাতালেই চিকিৎসা হয়নি স্বামী আমিনুলের (৫২)। সর্বশেষ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা দেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উদ্দেশে। ওই হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারা যান আমিনুল। সর্বশেষ সোমবার তিন ঘণ্টা হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের রিমন সাউদ (২৪)। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক করেন বাবা ইয়ার হোসেন (৬০)। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না- এ বিষয়টি ভাবা যায় না, এটা ঠিক হচ্ছে না। শুরুতেই বলা হয়েছিল, কভিড ও নন-কভিড রোগীদের জন্য পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। যাতে কেউ চিকিৎসাবঞ্চিত না হয়। কিন্তু হাসপাতালে রোগী গেলে বলা হচ্ছে অন্য কথা। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জরুরি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে হাসপাতাল থেকে রোগী ও তার স্বজনদের টেস্ট করানোর জন্য রেফারেন্স দেওয়া যেতে পারে। নইলে এমন রোগী নিয়ে স্বজনরা টেস্টের জন্য কোথায় দৌড়ঝাঁপ করবেন? স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর