মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

লিবিয়ায় সেই ক্যাম্পের মালিকসহ ৯ পাচারকারী গ্রেফতার

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় দালাল, দেশীয় পাচারকারী ও লিবিয়া ক্যাম্পের মালিকসহ ৯ পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে তাদের  গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান, লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু, মোছা. সানজিদা, সোহাগ হোসেন ও খালিদ চৌধুরী। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪টি পাসপোর্ট, দুটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সংবলিত দুটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়। গত রবিবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদিকে লিবিয়ায় মানব পাচারের ঘটনায় করা পল্টন থানার পৃথক দুই মামলায় তিন মানব পাচারকারীরকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মানব পাচার মামলায় দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ রিমান্ড ও কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন, বাদশা ফকির এবং লিয়াকত আলী ওরফে লেকু শেখ। জাহাঙ্গীর ও বাদশা এক মামলার আসামি। আর লেকু শেখ অপর মামলার আসামি।

এর আগে আসামি বাদশা ও জাহাঙ্গীরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক এস এম গফফারুল আলম। আর আসামি লেকু শেখকে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই আবুল বাশার মিয়া। এ ছাড়া কারাগারে যাওয়া দুই আসামি হলেন হযরত আলী ও নাজমুল হাসান। এদের আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী।

গত রবিবার লিবিয়ায় মানব পাচারের এক মামলায় সুজন মিয়া নামে এক আসামি দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পল্টন থানার আরেক মামলায় মাহবুবুর রহমান ও সাহিদুর রহমানকে চার দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

ডিবির গ্রেফতার ৬ : গতকাল রাজধানীর মিন্টু রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আবদুল বাতেন বলেন, মানব পাচারের ঘটনায় ভিকটিমদেরকে ভারত, দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়াতে পাচার করার পরিকল্পনা, প্রক্রিয়া করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিমানবন্দর, ঢাকাকে ব্যবহার করার কারণে ডিবি দায়ের করা মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে। লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া হতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অনঅ্যারাইভাল ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে লিবিয়ায় পাচার করে। লিবিয়ায় পাচার করে ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে। নির্যাতিত ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবার্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদের পাঠায় ও টাকা দাবি করে। ভিকটিমদের বাঁচাতে তার আত্মীয়-স্বজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিটাবাড়ি বিক্রি করে টাকা পাঠায়।

তিনি আরও বলেন, নিহত মাদারীপুরের ৭ জনকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে আমির হোসেনের কাছে পাচার করেছিল তার ভাই গ্রেফতার আকবর। গ্রেফতার বাদশা ১৩ বছর ধরে লিবিয়াতে অবস্থান করে। লিবিয়ার বেনগাজি, জোয়ারা শহরে তার নিজস্ব ক্যাম্প আছে। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে সে নিয়মিত লিবিয়াতে মানব পাচার করে, পাচারকৃত বাংলাদেশিদের তার ক্যাম্পে আটক রেখে ইতালিতে সমুদ্রপথে মানুষ পাঠানোর গামব্লিং করে। মাদারীপুরের নিহতদের মধ্যে ৪ জনকে তার ক্যাম্পে আটক রেখে ত্রিপোলিতে পাচার করার এক পর্যায়ে এ হত্যাকান্ড ঘটে।

আবদুল বাতেন বলেন, গ্রেফতার জাহাঙ্গীর ঢাকাতে অবস্থান করে নিজস্ব কায়দায় বেনগাজিতে মানব পাচার ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়াতে পাঠিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসা, অনঅ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করে, বেনগাজিস্থ ক্যাম্পে নির্ধারণ করে।

গ্রেফতার সুজন ভিকটিম ইছার উদ্দিন, বিজয় ও মো. সজলদের লিবিয়ায় পাঠায়। ২৮ মে লিবিয়ায় ট্র্যাজেডিতে ভিকটিম মো. সজল আহত হয়ে লিবিয়ার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। নিখোঁজ মো. বিজয় ও ইছার উদ্দিনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সিআইডির হাতে গ্রেফতার ৩ : সিআইডির অতিরিক্ত এসপি মো. ফারুক হোসেন জানান, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকান্ডের ঘটনায় করা মামলায় মানব পাচারে জড়িত চক্রের সদস্যদের ধরতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানের অংশ হিসেবে মোছা. সানজিদা, সোহাগ হোসেন ও খালিদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই মধ্যে সিআইডি বাদী হয়ে পল্টন থানায় দুটি ও বনানী থানায় একটি মানব পাচার মামলা করে। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এই পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত সারা দেশে ২২টি মামলার মধ্যে ১২টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। প্রসঙ্গত, গত ২৮ মে লিবিয়ার মিসদাহ উপ-শহরের মরুভূমিতে ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত করা হয় আরও ১১ জনকে। লিবিয়া এবং ইতালিতে অভিবাসী হতে যাওয়া শত শত বাংলাদেশি বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনে আহত, নিহত ও চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন। এসব ঘটনায় ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজনরা দেশের বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলা করে। এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত মানব পাচার মামলায় সর্বমোট ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সর্বশেষ খবর