শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে ত্রিমুখী আঁতাতে দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাকালে ত্রিমুখী আঁতাতে দুর্নীতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়েছে। আর দুর্যোগের সময় দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। করোনা নিয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর গতকাল এক কনফারেন্সে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় দেশে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। মাঠপর্যায়ে সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে একদিকে যেমন দলীয় বিবেচনায় তালিকা হয়েছে, তেমনি চুরি, আত্মসাৎ ও প্রতারণা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে রাজনীতিতে যারা প্রভাবশালী তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৯০ জন জনপ্রতিনিধিকে নামমাত্র সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। এদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। এ ছাড়া এন-৯৫ মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ক্রয়ের নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি হারে ক্রয়মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি। এই দুর্নীতিতে আমলাদের একটা অংশ জড়িত। মূলত ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিতে প্রভাবশালী মিলে ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে কাউকে বদলি বা বরখাস্ত করে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের তো জনপ্রতিনিধিত্ব করার অধিকার স্থায়ীভাবে হরণ করা উচিত। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের দিতে হবে। তবেই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন, করোনা মহামারীর সময় দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, সেখানে এই দুর্নীতির অর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে অবমাননা করা।

 এই অবমাননাকারীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও করোনাকালীন দুর্নীতিতে জড়িতরা পার পেয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, তারা কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী! মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার পেছনে বেসরকারি উদ্যোগকে দায়ী করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সবচেয়ে প্রথম যে প্রণোদনা দেওয়া হলো, সেটা পেলেন ব্যাবসায়ীরা। তারা বললেন, বেতন দিতে পারবেন না শ্রমিকদের। তারপর শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে আবার ঢাকায় আনা হলো। প্রফিটের প্রতি প্রাধান্য দেওয়ার সময় এটি নয়। ব্যবসায়ীদের করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। মানুষ যখন মানসিকভাবে সামাজিক দূরত্ব মানতে প্রস্তুত, তখনই গার্মেন্ট খুলে দেওয়া হলো। বিজনেস লবির চাপে সরকারও সেটা মেনে নিল। তাই বেসরকারি খাতের দায় রয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখনো সময় আছে সমন্বয় করে কাজ করার। আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত না নিয়ে নাগরিক সমাজের মতামত নিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই সামনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, করোনাকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা, হয়রানি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য প্রকাশ করায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো জবাবদিহি ছিল না। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা যে প্রকট, এই করোনাকালে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এই মহামারী মোকাবিলায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সুশাসনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বিব্রতকর ঘাটতি ছিল। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে করোনা পরীক্ষাগারের ঘাটতি আছে। এ ছাড়া সারা দেশের ৫৬টি পরীক্ষাগারের মধ্যে ঢাকায় ৩৪টি, যা রোগী শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে পরীক্ষার হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন এবং সারা পৃথিবীতে ১৪৯তম। অন্যদিকে এ কয় মাসে মেডিকেল বর্জ্য হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন, যা সঠিকভাবে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোর দৈন্যদশাও তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার তুলনায় আইসিইউ আছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে নেপালে আছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। রয়েছে ভেন্টিলেটরের সংকটও। এ ছাড়া জনবল সংকট বিশেষ করে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান নেই, যন্ত্রপাতি নেই, চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রী অপ্রতুল ইত্যাদি বিষয়ও উঠে এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।

১৫ দফা সুপারিশ : গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও জনবলের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা জেলা পর্যায়ে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে এবং বিদ্যমান সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে জেলা পর্যায়ে সার্বিকভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে জিডিপির ৫ শতাংশ। সব পর্যায়ের হাসপাতালে স্ক্রিনিং ও ট্রায়াল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সম্মুখসারির সব স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বিত চিকিৎসার প্রয়োজনে সব বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সব হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের নিয়মিত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ ও সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের তালিকা হালনাগাদ করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে; তথ্য প্রকাশ এবং তথ্যে প্রবেশগম্যতার সুবিধার্থে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের স্বার্থে গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণবিষয়ক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সাময়িক বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বশেষ খবর