শনিবার, ২০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যার ঝুঁকিতে দেশ

বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে পানি, বাড়ছে হুমকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যার ঝুঁকিতে দেশ

গোমতী নদী। কুমিল্লা নগরীর পাশে চানপুর এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই দুঃসময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। নদী সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে নদীতীরের অসহায় মানুষগুলোর। বন্যা ও ভাঙনের তোড়ে বসতভিটা ও ফসলি জমি, নিম্নাঞ্চলের কৃষিজমির সবজি খেত, পাট ও ভুট্টাসহ হাট-বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : সিরাজগঞ্জ : করোনা মহামারীর মধ্যে বন্যার শঙ্কায় নতুন আতঙ্কে ভুগছে সিরাজগঞ্জের যমুনাপাড়ের মানুষ।

যমুনার পানি গত এক সপ্তাহ ধরে দ্রুত বৃদ্ধির কারণে একদিকে ফসল-শাকসবজি তলিয়ে গেছে, অন্যদিকে নদীতীরে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। দুর্যোগের মধ্যে বন্যা-ভাঙন যেন নদীতীরবর্তী মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে যমুনাতীরের অসহায় মানুষগুলোর। প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি কয়েকদিন ধরেই দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিন যে হারে পানি বাড়ছে তাতে এক সপ্তাহের মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করবে বলে পাউবো জানিয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। শাকসবজি, পাট ও কাউনসহ চরাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে পানি বাড়ায় এনায়েতপুরের আড়কান্দি থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল পর্যন্ত নদীতীরে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। চৌহালীর বিস্তীর্ণ এলাকায় তীব্র হয়েছে ভাঙন। ভাঙনে বসতভিটা ও ফসলি জমি, হাট-বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাপ-দাদার ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। শাহজাদপুরে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থায়ী বাঁধের অন্তত ১০টি পয়েন্ট ধসে গেছে। সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হাবিবুল হক জানান, চরাঞ্চলের ৯০ একর জমির পাট ও ৫০ একর জমির তিল তলিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টির কারণে ৫৮০ একর জমির সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। পানি বাড়তে থাকলে বাদাম ও ভুট্টার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে যমুনার পানি যে হারে বাড়ছে গত ৩২ বছরের মধ্যে এত দ্রুত যমুনার পানি বাড়েনি। বন্যায় যেন বাঁধের কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য বালিভর্তি জিওব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

গাইবান্ধায় ২৮ পয়েন্টে নদীভাঙন

গাইবান্ধা : গত দুই সপ্তাহ ধরে গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, বাঙ্গালী নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে জেলা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার অন্তত ২৮ পয়েন্টে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত বেলকা, শ্রীপুর, হরিপুর, কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এ উপজেলায় অন্তত ১০ পয়েন্টে নদী ভাঙছে। বেলকা ইউপি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিলুল্যাহ জানান, তার ইউনিয়নের বেলকা, নবাবগঞ্জ ও কিশামতসদরে তিস্তার ভাঙনে ২০-২৫ বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ঝুঁকিতে আছে পঞ্চানন্দ, জিগাবাড়ি, রামডাকুয়া ও বেজির চর। সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানান, দীঘল মাইজবাড়ি, দীঘল চিথুলিয়া ও বাজে চিথুলিয়ায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ৮৫টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তাদের ২০০ বিঘা আবাদি জমি পাটসহ নদীগর্ভে চলে গেছে। পরিবারগুলো অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানী ইউনিয়নের ৫টি পয়েন্টে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদে হঠাৎ পানি বৃদ্ধির ফলে এই ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনরোধে এখনো পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করেনি। ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারী ও খাটিয়ামারী এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারী চরে ভাঙন তীব্র হয়েছে। গাইবান্ধা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, ভাঙনরোধে গাইবান্ধায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ অব্যাহত আছে। যেসব এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে সেসব এলাকায় বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি বাড়ছে

সিলেট : সিলেটের প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সবকটি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিলেট অঞ্চল ও উজানে ভারতের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টির ফলে নদীতে পানি বাড়ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল ৮ দশমিক ৯০ মিটার। গতকাল বিকাল ৩টায় তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ১৪ মিটার। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলসীদ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ১৩.৫৭ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল বিকাল ৩টায় তা বেড়ে ১৪ দশমিক ১ মিটার হয়েছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে যথাক্রমে বেড়েছে ২৫, ৩ ও ১০ সেন্টিমিটার। তবে এখনো সিলেটের সবকটি পয়েন্টে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকলে নদীর পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আবহাওয়া অধিদফতর।

পদ্মায় বাড়ছে পানি

রাজশাহী : বর্ষার শুরুতেই নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। পাশাপাশি ফারাক্কা বাঁধ হয়েও ভারত থেকে কিছু পানি আসছে। ভারতের গঙ্গা নদী রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে পদ্মা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় পদ্মার এসব এলাকা বিস্তীর্ণ বালুচরে পরিণত হয়। কেবল বর্ষা এলেই পদ্মা নদীতে পানি বাড়ে। রাজশাহী পাউবো জানিয়েছে, পদ্মার পানির উচ্চতা ১৮ দশমিক ৫০ মিটারের বেশি হলে তাকে বিপদসীমা অতিক্রম হিসেবে ধরা হয়। গত ১৫ বছর মাত্র দুই বার পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পদ্মাপাড়ের জেলেরা জানিয়েছেন, নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় জালে দেশি ছোট মাছ ধরা পড়ছে বেশি। তাই জেলেরা নৌকা-জাল নিয়ে নেমে পড়েছেন পদ্মায়। এসব জেলে কয়েক মাস আগে থেকেই নতুন নৌকা-জাল তৈরি করে পদ্মায় পানি বাড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, মৌসুমি বায়ু আগাম বিস্তার লাভ করায় এবার বর্ষার আগেই বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা মৌসুমেও বেশি হতে পারে বৃষ্টির পরিমাণ। ফলে চলতি জুনের শেষ নাগাদ নদীর পানি আরও বাড়বে। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে বন্যা হতে পারে।

ব্রহ্মপুত্রে বাড়ছে পানি

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে গত তিন দিন ধরে জেলার ১৬টি ছোট বড় নদ-নদীর পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু গতকাল তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমলেও ব্রহ্মপুত্র নদের দুটি পয়েন্টে পানি আরও বেড়েছে। ফলে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের নদীর বিভিন্ন চরাঞ্চলে ও চিলমারী উপজেলার নদীর সবকটি চরে পানি বেড়ে গিয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমতে শুরু করায় দক্ষিণদিকে ব্রহ্মপুত্রে পানি বেড়েছে। পাউবো জানায়, এ অবস্থায় বন্যার সৃষ্টি না হলেও নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। এ নদের চিলমারী পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর