ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করা সাইফুদ্দিন নাসিরের স্ত্রীর বড় বোন রেবেকা সুলতানা (৪৫) কিডনি রোগে আক্রান্ত। এ নারীকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো। সম্প্রতি রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে গিয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জানান, রেবেকা সুলতানার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাদের হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা হয় না, তাকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে যেতে বলা হয়। সাইফুদ্দিন বলেন, সকাল ৯টার দিকে ফোন পেয়ে আমি বিআরবি হাসপাতালে যাই। তারা আমাদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করে। অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে নিয়ে যাই হার্ট ফাউন্ডেশনে। তারা বলেন, তাদের ওখানে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই, তাই রোগী ভর্তি রাখবে না। সেখানে থেকে গেলাম স্কয়ার হাসপাতালে। তারা বলল, তাদের আইসিইউ খালি নেই। আয়শা মেমোরিয়ালে যোগাযোগ করলে তারা বললেন, করোনার টেস্ট ছাড়া রোগী ভর্তি করবেন না। গেলাম ইমপালস হাসপাতালে। তারা বললেন, তাদের ওখানে অনেক করোনা রোগী ভর্তি আছেন। নতুন রোগী রাখবেন না। নিরুপায় হয়ে বারডেম হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা করে আইসিইউতে ভর্তি করাতে বললেন। কিন্তু আইসিইউর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকরা টেস্ট ছাড়া ভর্তি করাতে রাজি হলেন না। অনেক অনুনয় করেছি, তদবিরও করিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। বিকাল ৪টার দিকে রোগী মারা যান। হাসপাতাল থেকে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলে সনদও দেওয়া হয়। গত ৯ জুন চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকার বাসিন্দা দুই সন্তানের জননী ফাতেমা আক্তার মুক্তাকে (৩০) প্রথমে মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্ট পেলেও দরকার হয় আইসিইউ। কিন্তু ওইদিন কোথাও আইসিইউ বেড না পেয়ে মারা যান সন্তানসম্ভবা ওই নারী।
শুধু এই দুজনই নন, আইসিইউর অভাবে প্রতিনিয়তই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই কভিড-নন কভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ সংকট চরমে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও মিলছে না আইসিইউ। অনেকে রাস্তায়ও মারা যাচ্ছেন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের কাগজেকলমের হিসাবে দেখাচ্ছেন আইসিইউর অভাব নেই। অনেক আইসিইউ ফাঁকা পড়ে আছে। রোগী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক তদ্বির করেও মেলে না আইসিইউ। আবার কখনোবা মিললেও গলা কাটার মতো চিকিৎসা ফি রাখা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সারা দেশে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৪২১টি। এর মধ্যে ঢাকায় আইসিইউ বেড আছে ২০২টি। এখন পর্যন্ত আইসিইউ বেডে ভর্তি রোগী সংখ্যা ১৯৬ জন। তাদের তথ্যমতে, বর্তমানে ২২৫টি আইসিউ বেড খালি পড়ে আছে। তবে কোথায় এসব ফাঁকা আছে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ঢাকা মহানগরে কভিড রোগীদের জন্য সাধারণ বেড আছে ৫ হাজার ৯৮৫টি। সব বিভাগে সাধারণ বেডের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৪৮টি। সারা দেশে হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ১০ হাজার ৮৬৬টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ১০২টি এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের সংখ্যা ৯৮টি।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ওয়াটার এইডের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা হয়েছে যে, কোনো হাসপাতালে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য শয্যা খালি নেই। কোন হাসপাতালে কয়টি আইসিইউ এবং সাধারণ শয্যা খালি আছে সেটি প্রতিদিন প্রকাশ করা উচিত। এই পরিসংখ্যান যদি জানানো হতো, মানুষজনও তাহলে সে অনুযায়ী এলাকা বাছাই করে যেতে পারত এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারত। জানা যায়, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতেও নেই ভেন্টিলেটর সুবিধা। আইসিইউ সুবিধা না থাকায় মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয় স্বজনদের। রোগী মুত্যৃর ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের একজন পরিচালক মারা গেছেন। প্রয়োজন থাকলেও তার জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা হচ্ছিল না। ভেন্টিলেশন সাপোর্ট না থাকায় তার শ^াসকষ্ট শুরু হয়। তার ভাইয়ের ভেন্টিলেশন খুলে তাকে দেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইসিইউ-ভেন্টিলেটর। যার অভাবে প্রতিদিনই বিশ্বে হাজার হাজার করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। এর সংকট রয়েছে বাংলাদেশেও। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার পাশাপাশি শ্বাসকষ্টসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ অত্যাবশ্যকীয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে করোনা মোকাবিলায় কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার আইসিইউ ও ৫ হাজার ভেন্টিলেটর প্রস্তুত করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, কভিড-১৯ এ আক্রান্ত মোট রোগীর ৮০-৮২ শতাংশ সাধারণ চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। বাকি ১৮-২০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা নিতে হয় হাসপাতালে। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ রোগীর জন্য প্রয়োজন হতে পারে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সুবিধা বা ভেন্টিলেটর। আর জটিল ৫ শতাংশের জন্য লাগতে পারে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা রোগীদের মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকায় আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সাপোর্ট ছাড়া করোনা রোগীদের চিকিৎসা খুব মুশকিল। কারণ করোনায় শ^াসকষ্টের রোগীর যে কোনো সময় অবস্থা খারাপ হতে পারে। ভেন্টিলেশন ছাড়া চিকিৎসার প্রস্তুতি শূন্যের কোঠায়। দেশে কমপক্ষে ৫ হাজার ভেন্টিলেটর দরকার। সরকারি-বেসরকারি আইসিইউর দায়িত্বে থাকা নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক রেজা মুজাম্মেল জানান, বন্দর নগরীতে ১৬ আইসিইউ শয্যাই ভরসা মুমূর্ষু রোগীর। চট্টগ্রামে জনসংখ্যা এক কোটির বেশি। এক মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন ১৭০ থেকে ১৮০ জন করে। এর মধ্যে মুমূর্ষু সংকটাবস্থায় দৈনিক গড়ে মারা যাচ্ছেন দুই থেকে তিনজন। এমন সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসায় অতি জরুরি সেবায় প্রয়োজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রামে সরকারি দুই হাসপাতালে আইসিইউ আছে মাত্র ১৬টি। এগুলোই সংকটাপন্ন রোগীর ভরসা। জানা যায়, করোনাভাইরাস আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আছে ছয়টি এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আছে ১০টি আইসিইউ শয্যা। কিন্তু জেনারেল হাসপাতালে ২০১৪ সালে আনা আটটি আইসিইউ এখনো চালু করতে পারেনি। ফলে আইসিইউ সংকটে প্রতিদিনই রোগী মারা যাওয়ার অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো সীমিত পরিসরে করোনা আক্রান্ত এবং উপসর্গের রোগী ভর্তি করাচ্ছে। এ কারণে এখন শ্বাসকষ্টের রোগীর আইসিইউ সংকট কমছে। কিন্তু এসব বেসরকারি হাসপাতালে গরিব-অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষের যাওয়ার সুযোগ নেই। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভরসা সরকারি দুই হাসপাতাল। চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘এ হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউতে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা চলছে। তবে এখন আইসিইউর চেয়ে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ এবং হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা জরুরি। এ দুটি সেবা দিয়েই অনেক রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। তাই এখন এ দুটি চিকিৎসার দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব বলেন, ‘এখানে বর্তমানে ১০টি আইসিইউ চালু এবং আরও আটটি চালুর অপেক্ষায় আছে। সব চালু হলে এটি হবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বৃহৎ আইসিইউ সেন্টার। তাছাড়া এখন মুমূর্ষু রোগীর জন্য জরুরি হচ্ছে অক্সিজেন। এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানোর কাজ চলছে।’ জানা যায়, সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক নুরুল আলম ২০ জুন সকালে অসুস্থ হলে স্থানীয় বিএসবিএ হাসপাতাল, সেখান থেকে ইউএসটিসিতে নিয়ে যায়। সেখানে করোনা রোগী ভর্তি করা হয় না বলে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও রোগী দেখেননি। পরে পার্শ্ববর্তী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তার পালস কাজ করছে না বলে দ্রুত চমেক হাসপাতালে নিতে বলেন। এ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নগরের দক্ষিণ নালাপাড়া প্রীতি বিকাশ দত্তের বুকে ব্যথা উঠলে ছেলে অভিজিৎ দত্ত বাবাকে নিয়ে যান মা-মনি হাসপাতাল, ম্যাক্স, ন্যাশনাল হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও মেলেনি চিকিৎসা। পরে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছেলের সামনেই তিনি মারা যান। গত ১০ জুন নগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মো. কামাল উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে মা ও শিশু হাসপাতাল, সেখানে অক্সিজেন না পাওয়ায় পার্কভিউ, ম্যাক্স ও মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেওয়া হয়। করোনা সন্দেহে ভর্তি নেয়নি কোথাও। পরে ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান।