বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
জেকেজির জালিয়াতি, সাবরিনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ

ডিবির জেরা স্বাস্থ্যের ডিজি-এডিজিকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) প্রতিষ্ঠানের করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে  ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাদের মধ্যে রয়েছেন সদ্য পদত্যাগ করা স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং অপরজন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। গতকাল অধিদফতরে গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন ডিবির কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (জেসি) মো. মাহবুব আলম বলেন, করোনা পরীক্ষার বিষয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে কিছু কাগজপত্র চেয়ে অধিদফতরে গিয়ে তাদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কী কী বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তা জানতেই তাদের ডেকেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে চেয়ারম্যান হিসেবে নয়, জেকেজি হেলথকেয়ারের আহ্বায়ক হিসেবে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এ মামলায় আমরা দ্রুতই চার্জশিট দিতে পারব।’

গ্রেফতারের আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডা. সাবরিনা নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান পরিচয় দিলেও ডিবির তদন্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো ডকুমেন্ট আমরা পাইনি। তবে আহ্বায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত থাকার কাগজ পাওয়া গেছে।’ করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট জালিয়াতির মামলায় সাবরিনা দুই দফা রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। জালিয়াতির অভিযোগ থাকায় ১২ জুলাই ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকে তেজগাঁও থানা পুলিশ। তবে কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় তাকেও গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৩ জুলাই সাবরিনার তিন দিনের ও ১৭ জুলাই ফের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।

জানা গেছে, জেকেজি হেলথকেয়ারের একটি ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত ছিল না। এর পরও স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে। আর নমুনা সংগ্রহের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। ইতোপূর্বে রিমান্ডে পুলিশের জেরায় সাবরিনা এসব তথ্য দিয়ে ফাঁস করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগকে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য করে রেখেছেন এই সাবরিনা। আর ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন ‘ইউনিটপ্রধান’ পদের একজন ডাক্তার। সেই ডাক্তারের ছত্রচ্ছায়ায়ই অনিয়মের চূড়ায় উঠেছিলেন সাবরিনা। দিনের পর দিন কাজ না করেই নিতেন বেতন। সুনজরে থাকায় অনুপস্থিত থাকার পরও সাবরিনার নাম উঠে যেত হাজিরা খাতায়। পুলিশের এ তদন্তের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবরিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, সরকারি চাকরি করেও ডা. সাবরিনা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ বাগাতেন। এর বাইরে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড, বিশিষ্টজনের নাম ভাঙিয়ে ফায়দা নেওয়া, হুমকি-ধমকি, সন্ত্রাসী বাহিনী লালনপালনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। জেকেজির সিইও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী গ্রেফতারের পর থেকেই নিজের গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন স্থানে তদবির করছিলেন সাবরিনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারদলীয় নেতা, চিকিৎসক নেতাদের দ্বারস্থ হন। কেউ কেউ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশের সূত্রগুলো জানিয়েছেন, সাবরিনা গ্রেফতার এড়াতে প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন।

প্রতারণা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই ডা. সাবরিনা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। জেকেজির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করে আসছিলেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও সাফ বলেছেন তিনি জেকেজির কেউ নন। কিন্তু ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে এটা আগে থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায় সরকারি চাকরির পাশাপাশি তিনি জেকেজির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সূত্র জানান, অনুমোদনহীন জেকেজির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর নমুনা সংগ্রহের চুক্তি করে ১৬ এপ্রিল। জেকেজির এ সময় কোনো ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত ছিল না। চুক্তি করার দুই মাস পর ১৬ জুন জেকেজির ট্রেড লাইসেন্স করা হয়। যার মালিক জেবুন্নেসা রীমা। জেবুন্নেসা হলেন সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরীর বোন। তিনিও প্রতারণা মামলার আসামি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তির পর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী করোনার ভুয়া টেস্টের মাধ্যমে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। জেকেজি হেলথকেয়ারের মাধ্যমে ২৭ হাজার মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে ১৫ হাজার ৪৬০টি জাল সনদ দিয়ে এ টাকা হাতান। আর এ অভিযোগেই ১২ জুলাই পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশনের উপকমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাবরিনাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এর আগে ২৩ জুন জেকেজির সাবেক দুই কর্মী হুমায়ুন কবির হিমু ও তার স্ত্রী সিস্টার তানজিনাকে করোনা পরীক্ষার জাল রিপোর্ট তৈরির অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যমতেই জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালিয়ে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর স্বামী আরিফ চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানের আরও কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে জেকেজির সিইও হলেন আরিফ চৌধুরী ও চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। যদিও আরিফ চৌধুরীসহ অন্যরা গ্রেফতারের পর থেকে সাবরিনা চৌধুরী নিজেকে এ প্রতিষ্ঠানের কেউ নন বলে দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু পুলিশ ব্যাপক তদন্ত ও নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানতে পারে জেকেজির সঙ্গে সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর