শিরোনাম
শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
মেডিকেলে ভর্তি কেলেঙ্কারি

সিন্ডিকেট ও গডফাদারদের চলছে সম্পদের খোঁজ

সারা দেশে ৪০ সদস্য সক্রিয়, হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা

মাহবুব মমতাজী

মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত একই পরিবারের সাত সদস্য। ২০১৩ সাল থেকে এরাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের ছাপাখানা থেকে বারবার ফাঁস করেছে প্রশ্নপত্র। এই সাত বছরে তারা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা। পারিবারিক এ সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড ছাপাখানার মেশিনম্যান আবদুস সালাম খান ও তার খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। পারিবারিক এ প্রশ্নফাঁস চক্রের ৪০ সদস্য সারা দেশে এখন সক্রিয়। এদের শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি খোঁজ পেয়েছে, সারা দেশের ৩৬টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে প্রতি বছরই দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, যারা পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছিল। চক্রে একই পরিবারের অন্যরা হলোÑ জসিমের ভাতিজা পারভেজ খান, জসিমের ভগ্নিপতি জাকির হোসেন দীপু, জসিমের ভায়রা সামিউল জাফর, জসিমের স্ত্রী শারমিন শিল্পী ও জসিমের ভাগ্নে রবিন। এদের মধ্যে শুধু জসিমেরই ৪০ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। এ সম্পদ দেখিয়ে সে করোনা মহামারী শুরুর আগে কানাডায় ইমিগ্রেশন নিতে চেয়েছিল। তবে সিআইডির ধারণা, সে শত কোটি টাকার বেশি মালিক। আর মেশিনম্যান সালাম খানের ক্ষমতার উৎস ছিল স্বাস্থ্য খাতে হাজার কোটি টাকা লোপাটের আলোচিত দম্পতি আবজাল হোসেন ও রুবিনা খানম। তারা দুজনই এখন অস্ট্রেলিয়ায়। সালামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার কাশিপুর গ্রামে। তার খালাতো ভাই জসিমের বাড়ি একই উপজেলার বানিয়ারা গ্রামে। মাস্টারমাইন্ড আবদুস সালাম খান এখনো গ্রেফতার হয়নি। অপর মাস্টারমাইন্ড জসিমকে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর শাহআলী থানার এইচ-ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৪৩ পৃথ্বী ভিলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। একই এলাকার এ-ব্লকের ১ নম্বর রোডের ২৯ নম্বর বাসা থেকে গ্রেফতার হয় জাকির হাসান দিপু। আর পারভেজ খানকে গ্রেফতার করা হয় মিরপুর-২ এর চ-ব্লকের ৯১/৯২ নম্বর বাড়ি থেকে। এ ঘটনায় পর দিন ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অন্তত ১৫০-২০০ জনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করে সিআইডি। ওই তিনজনই এখন সাত দিনের রিমান্ডে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছে বলে স্বীকার করেছে তারা।

পৃথক একটি অভিযোগে ২০১৬ সাল থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে আছে আবদুস সালাম খান। এরপরও নিজস্ব গড়ে তোলা বলয়ের মধ্যদিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গেছে সে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ওই প্রেসে সালামের চক্রের আরও কিছু লোক থাকতে পারে। যাদের মাধ্যমে সে প্রশ্ন বের করে আনত। মিরপুর-২ এর প্রশিকার মোড় থেকে সবখানে সরবরাহ করা হতো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র।

যেভাবে ফাঁস প্রশ্নপত্র : ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মেডিকেল ভর্তির পরীক্ষার আগের রাতে ১২টার পরে সালাম খান প্রশ্নপত্র এনে দেয় জসিমের কাছে। এরপর জসিম প্রশিকার মোড়ে এসে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য সানোয়ারকে ফাটোকপি করে দেয়। সানোয়ার মোবাইলে ছবি তুলে চক্রের অন্য সদস্য রওশন আলী হিমু, আলমাস এবং সাজ্জাদের ফেসবুকের মেসেঞ্জারে পাঠাত। এদের কাছ থেকে চক্রের আলমগীর, জেড এম এ সালেহীন ওরফে শোভন, আক্তারুজ্জামান খান তুষার, রাশেদ খান মেননসহ দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও খুলনায় থাকায় সদস্যরা ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করে। পরের বছর ২০১৪ সালে পারভেজ খান, ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, রেদওয়ানুর রহমান শোভন হিমু, নেরু, জনি, রিয়াদ শুভ ও নিশাত চক্রের আরও কয়েকজন সদস্য পরীক্ষার আগে থেকে অন্তত ৫০ জন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আগে থেকে টাকা নেয় প্রশ্ন সরবরাহের কথা বলে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া ভর্তি পরীক্ষার আগে সানোয়ার, জাকির হোসেন দিপুসহ চক্রের অন্যরা আগে থেকে সংগ্রহ করা ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে চেক, টাকা, ভোটার আইডি কার্ড, শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্রের কপি, যোগাযোগের মোবাইল নম্বর ও মেডিকেলে ভর্তির আবেদনের ফটোকপি জসিমের পৃথ্বী ভিলার বাসায় জমা রাখত। এরপর ওই বছর পরীক্ষার আগের রাতে সালামের সহযোগিতায় জসিম তার ভায়রা সামিউল জাফর সিটু ও স্ত্রী শারমিন আক্তার শিল্পীকে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দিত। এরপর শিল্পী চুক্তি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ওই প্রশ্ন পৌঁছে দিত। ওই বছর ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল তাদের কয়েকজনের নাম পেয়েছে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, শোভন নামে এক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় খুলনা মেডিকেল কলেজে, মাহমুদা পারভীন ঋতু বরিশাল মেডিকেল কলেজে, রিয়াদ, সিলেট ওসমামী মেডিকেল কলেজে এবং মুবিন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেলেও ভর্তি হয় বেসরকারি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিকেল কলেজে। ২০১৬ সালে জসিম ফাঁস করা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতে কুমিল্লা লাকসামের তৎকালীন একজন চেয়ারম্যানের ছেলে এবং নীলক্ষেতের দোকানদার ফরিদের সঙ্গে চুক্তি করে। ২০১৭ সালেও ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের ভর্তির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে জসিম ও সালাম। ওই বছর ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোহাইমেনুল ইসলাম বাঁধনের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ভর্তিচ্ছুদের মাঝে সরবরাহ করে। এখানেও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে তারা। তদন্তে প্রশ্নপত্র সরবরাহে লেনদেনে যাদের নাম পেয়েছে তাদের প্রত্যেককে মিরপুর থানায় করা মামলায় আসামি করেছে সিআইডি।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পুরনো অফিসে স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপন করা হয়। ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, ডেঙ্গুর বিভিন্ন সচেতনতামূলক লিফলেট ও পোস্টার ছাপানোর পাশাপাশি ১৯৮৮ সাল থেকে এখানে ছাপা হয় মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও। শুরু থেকেই এখানে মেশিনম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবদুস সালাম খান। সেখানে আনাগোনা ছিল জসিমেরও। গণমাধ্যমকে প্রেস ম্যানেজার ফায়েজুর রহমান জানিয়েছেন, প্রশ্ন সরানোর অভিযোগে ২০০৬ সালে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সালামকে। ২০০৯ সালে তাকে আবারও একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর