বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

যেখানে তদন্ত সেখানেই কেলেঙ্কারি

স্বাস্থ্য আর্থিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে তদন্ত হলেই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি-অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি যেন থামছেই না। স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, উন্নয়ন খাত, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, শিক্ষা খাত, পূর্ত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, সেবা খাত সর্বত্র দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। এসব খাতের যেখানে যেখানে দুর্নীতি হয় বা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে। তবুও বন্ধ হচ্ছে না দুর্নীতি। এ যেন যেখানেই তদন্ত সেখানেই স্পষ্ট দেখা যায় হরিলুট পরিস্থিতি। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির যেসব ঘটনা জনসম্মুখে এসেছে সেগুলো তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারীরা আঁতকে উঠছেন। তদন্তে বেরিয়ে আসছে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য। এ যেন শত কোটি টাকার দুর্নীতি তো নস্যি; হাজার কোটি টাকার নিচে কোনো দুর্নীতি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যতদিন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে না। রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করার কারণে দুর্নীতি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তাই দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন  বন্ধ করা। একই সঙ্গে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে দেশের সম্পদ লুট করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তাহলে নতুন করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নিরুৎসাহিত হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করার নামে যে তামাশা চলছে সেটা আগে বন্ধ করতে হবে।

ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ভয়াল দুর্নীতি গত কয়েক বছর ধরে আলোচনায়। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সেই টাকা যথাযথ জায়গায় ব্যবহার না করে পাচার করা হয়েছে বিদেশে। এমনকি ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত প্রশান্ত হালদারের মতো লোকজনও ব্যাংক থেকে টাকা পাচার করে পালিয়ে গেছে কানাডায়। তার টিকিটির নাগালও পাচ্ছে না তদন্তকারী সংস্থা। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি তো দেশের মানুষকে ‘পীড়িত’ করেই চলেছে। এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি হচ্ছে- যা একেবারে ওপেন সিক্রেট। তারপরও স্বাস্থ্য খাতের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কখনই কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং তারা রাজার হালেই নিজেদের দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। করোনার মহামারীকালেও মাস্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা অনেক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহের ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে উন্নতমানের মাস্কের বদলে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করেছে। যা করোনা চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের মৃত্যুঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে চিকিৎসকরাও প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো রকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মাস্ক কেলেঙ্কারি তো সেদিনের কথা! বহু বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে। সেই প্রতিযোগিতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। যার ইশারায় চলে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিটা হয় বড় ধরনের। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন তারা কে কোন হাসপাতালে কী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবেন। সেই অনুযায়ী তারা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর থেকে সরবরাহ তালিকা অনুমোদন করে নেন। তারপর জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা সরকারি অন্য হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে একটি তালিকা সরবরাহ করে দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানান। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইতস্তত করলে দাপুটে ঠিকাদাররা হয় তাদের ম্যানেজ করেন, না হলে ওপর থেকে ফোন করিয়ে দরপত্র আহ্বান করতে বাধ্য করান। অর্থাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী কোনো হাসপাতালের কোনো জরুরি পণ্য ক্রয় করতে পারেন না। ঠিকাদারদের ইচ্ছায় তাদের সবকিছু কিনতে হয়। হাসপাতালের চাহিদা বা প্রয়োজন না থাকলেও ঠিকাদারদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করে পণ্য কিনতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঠিকাদার সিন্ডিকেট এসব নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অনেক জেলা শহরে বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতি ব্যবহার না হওয়ায় পড়ে আছে বছরের পর বছর। কারণ ওইসব যন্ত্র চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল নেই। এতে করে সরকারের শত শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। আর অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে কাঁচা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মিঠু সিন্ডিকেট। রূপপুরের বালিশ কান্ড কিংবা ফরিদপুর হাসপাতালের পর্দাকান্ড থেকে শুরু করে যেসব দুর্নীতির খবর ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, টাকার অঙ্কে এসব দুর্নীতির আকার অনেক বড়। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বাইরে রাজনৈতিক পরিচয়েও দুর্নীতি থেমে নেই। রাজধানীর গন্ডি পেরিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে এই দুর্নীতি। ফরিদপুরে দুর্নীতির মাধ্যমে দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হোসেন রুবেলের অর্থবিত্ত বানানোর ঘটনা তো একেবারে পিলে চমকানোর মতো। ফরিদপুরে দুর্নীতি এতটাই ডালপালা মেলেছিল যে সেখানে দুই ভাই দুর্নীতি করে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসী একটি কর্মকান্ডের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তাদের গ্রেফতার করা হলে তদন্তে নেমে তদন্তকারী সংস্থা জানতে পারে তারা দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি মালিক। যা তারা পাচার করেছেন। এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলোর তদন্তে নেমে তদন্তকারী কর্মকর্তারা পেয়েছেন চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির তথ্য। পাপিয়াকা-ও তার একটি বড় উদাহরণ।

সর্বশেষ খবর