রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বাণিজ্য বিনিয়োগ সেবা ব্র্যান্ডিং

কী করছে মিশনগুলো

সদা তৎপর বিদেশি দূতাবাসের বিপরীতে নিষ্প্রভ বাংলাদেশের মিশনগুলো

জুলকার নাইন

সাধারণ সময়ে বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি দূতাবাসের কূটনীতিকদের প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। কূটনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তারা যতটা না যান তার চেয়ে বেশি যান অন্যান্য দফতরে। মূলত নিজ নিজ দেশের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ খুঁজতেই তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তদবির বা দেন-দরবার করেন। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সরকারি বাণিজ্যের চেয়ে প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের আলোচনাই বেশি করতে দেখা যায় তাদের দূতাবাস কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবসা পাইয়ে দেন বিদেশি কূটনীতিকরা। নিয়মের মধ্যে থেকেই বিদেশি দূতাবাসগুলো গুরুত্বের সঙ্গে এসব কাজ করছে বলে জানালেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের পদস্থ এক কর্মকর্তা। সরকারি এই কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশের মতো দেশেই পশ্চিমা রাষ্ট্র থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিটি দূতাবাস এসব ক্ষেত্রে খুবই সক্রিয়। এ থেকেই বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী তাদের দূতাবাসগুলো বাণিজ্য বাড়াতে একই ধরনের ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে থাকা বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন দীর্ঘ সময় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করা এই সরকারি কর্মকর্তা।

হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন দেশের এক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের          কর্ণধার। বৃহতাকারে উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত এই শীর্ষ ব্যবসায়ী জানালেন, শুধু সরকারি প্রকল্পগুলোতে নয়, এ দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট শিল্প-কলকারখানায় নিজ নিজ দেশের  কোম্পানির মালামাল সরবরাহের কাজেও বিদেশি কূটনীতিকরা তৎপর। কাঁচামাল সরবরাহ বাড়াতে দূতাবাসগুলো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। তারা শুধু বিদেশি কোম্পানিগুলোর এ দেশে বিনিয়োগের সুরক্ষাই দেখাশোনা করেন না, পাশাপাশি নিজ দেশের কল-কারখানার নতুন ধরনের প্রোডাক্ট সম্ভাব্য যেসব স্থানে সরবরাহ সম্ভব সেখানে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করে বিদেশি দূতাবাসগুলো। এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা জেনে তারা নিজ দেশের কোম্পানির কাছে জানায়, সেই হিসেবে সরবরাহও পাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো থেকে এমন সেবা আশাই করা যায় না বলে মন্তব্য করে এই ব্যবসায়ী বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো নিজেরা  খোঁজখবর নিয়ে বাণিজ্যের সুযোগ দেখে দূতাবাসে যোগাযোগ করলে সরকারি আদেশ-প্রক্রিয়ার ‘হাইকোর্ট’ দেখানো হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিভিন্ন ধাপ শেষ করে দূতাবাসগুলোর ভূমিকার ধাপে পৌঁছানো গেলেও সেটা রোড শো বা অনাড়ম্বর মেলার মধ্যেই সীমিত থেকে। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর টাকায় এক দিনের সেই আয়োজনের পর আর কোনো ফিডব্যাক থাকে না। দূতাবাস সরকারি ফাইলপত্রে সেই রোড শো ও মেলার আয়োজনকেই সাফল্য বলে দাবি করে।

কেন মিশনগুলো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত থাকা হুমায়ূন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা যথেষ্ট দক্ষ ও তীক্ষè। কিন্তু সঠিক পেশাদার দিকনির্দেশনার অভাবে তাদের দক্ষতা ও তীক্ষèতা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, মিশনগুলোতে পেশাদার কূটনীতিকদের বাইরে গিয়ে বাহুল্য রাজনৈতিক নিয়োগও পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। দায়িত্ব পালনে সাফল্যের চেয়ে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা অন্যান্যভাবে যখন রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্তরা পেশাদারদের চেয়ে বেশি মূল্যায়িত হন তখন এর প্রভাব অন্যদের মধ্যেও পড়বে- এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন সাবেক এই  পেশাদার কূটনীতিক। পররাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে দূতাবাসগুলো রাত-দিন কাজ করে বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের এমন ৭৭টি মিশন পরিচালিত হচ্ছে। এসব দূতাবাস পরিচালনায় প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এই ব্যয় ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। কারণ আগামী এক বছরের মধ্যে মিশন সংখ্যা ১০০ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১১টি নতুন মিশন চালু হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যেসব দেশে মিশন নেই পার্শ¦বর্তী মিশনগুলো সেখানকার দেখভালের দায়িত্বে আছে। দূতাবাসগুলো কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা,  চুক্তি-সমঝোতা, রাষ্ট্র ও প্রধানের সফর আয়োজনের মতো গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি প্রায় ২৭ দফা রুলস অব বিজনেস অনুসরণ করে। এর মধ্যে একটি হলো- অর্থনৈতিক, কারিগরি, ব্যবসা ও বাণিজ্যের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক প্রচার, বাংলাদেশিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ। কিন্তু বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের লাইনও দীর্ঘ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, দূতাবাসের নিয়মিত সেবা পেতেও  ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এর ফলে অনৈতিক ঘুষ বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। কিছু ক্ষেত্রে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দালাল তোষণের অভিযোগও আছে। পাশাপাশি প্রবাসীদের বড় একটি অভিযোগ, বিপদে আপদে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে অন্যান্য দেশের দূতাবাসের মতো পাশে পাওয়া যায় না। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে পারছে না দূতাবাসগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে দরকষাকষি এবং কর্মক্ষেত্রের আগাম নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় তদারকি হচ্ছে না। দ্বৈত নাগরিকদের অভিযোগ, দূতাবাসের সবক্ষেত্রেই দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়। বিদেশি সহকর্মী-বন্ধুবান্ধবদের ভিসা নিয়ে প্রায়ই জটিলতা হয়। অভিযোগ করেও পাওয়া যায় না প্রতিকার। দেশের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশকেই তাদের বার্ষিক টার্গেট অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে দেখে। নতুন বাণিজ্য বিনিয়োগ খুঁজতে বা বাড়াতে দূতাবাসগুলোর তেমন কোনো আগ্রহ না থাকায় ভূমিকাও নেই। এমনকি বিশ্বে চাহিদা থাকা বাংলাদেশি গার্মেন্ট, চামড়া ও ওষুধের মতো প্রচলিত পণ্যেরও নতুন বাজার তৈরিতে চোখে পড়া সাফল্য নেই দূতাবাসগুলোর। মিশনগুলোর প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সফলতা দেখা যাচ্ছে না। কেবল টাকা দিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ ছাড়া বিদেশে গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার কাজটিও হয়নি সেভাবে। এসব দায়িত্ব পালনের বাইরে গিয়ে মিশনগুলোর ব্যস্ত থাকতে হয় ভিভিআইপি ও ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে। দুবাই, ইস্তাম্বুলের মতো ট্রানজিট পয়েন্টের মিশনগুলোর একের অধিক কর্মকর্তার চাকরিজীবনই কাটছে বিমানবন্দরে। মিশনগুলো যখন প্রটোকলে ব্যস্ত তখন সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শ্রমঘন মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করে ইউরোপের দেশ গ্রিসে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া পেশাদার কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ বলেন, কয়েক লাখ প্রবাসীর বিপরীতে মিশনগুলোতে ৮-১০ জন কাজ করেন। এই কয়েকজনকেই দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমিক সম্পর্ক, ক্রীড়াসহ সব বিষয় দেখভাল করতে হয়। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনায় এই রাষ্ট্রদূত বলেন, দূতাবাসগুলোর রিসোর্সের যথেষ্ট অভাব থাকার পরও যতটুকু সম্ভব তা করার চেষ্টা করছে। বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলামের মতে, প্রয়োজনীয় লোকবল ও অর্থ, প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন ও সঠিক নেতৃত্বের পাশাপাশি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের মতে, পরিস্থিতি উত্তরণে দুটি বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, যে মন্ত্রণালয়গুলো এই দূতাবাসগুলোয় লোক পাঠায়, ঢাকায় তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় করা। দ্বিতীয়ত, যারা দূতাবাসে কাজ করতে যাবেন, তাদের জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যেন তারা নতুন দেশে, নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কাজের ধরনের সঙ্গে সহজেই খাপখাইয়ে নিতে পারেন। যারা এই প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হবেন, শুধু তাদেরই মিশনে পাঠানো প্রয়োজন।

বাণিজ্য বিনিয়োগ ও সেবার মান বাড়াতে বাড়তি নজর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দূতাবাসগুলোর সেবার মান নিয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে উচ্চকণ্ঠ থাকা ড. এ কে আবদুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বাণিজ্য বিনিয়োগ ও প্রবাসী সেবার মান বাড়ানোর বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২৪ ঘণ্টা দূতাবাসের দরজা খোলা রাখার লক্ষ্য নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে আদেশ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি মিশনের কাছ থেকে তিন বছরের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর রূপরেখা নিয়ে সেগুলোর ত্রৈমাসিক-ষাণ¥াসিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর