শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
সহযোগী সংগঠনে বেহাল দুই দল

মাইম্যান রাখতেই বিএনপির অঙ্গ সংগঠন গোছানোয় বিলম্ব

মাহমুদ আজহার

মাইম্যান রাখতেই বিএনপির অঙ্গ সংগঠন গোছানোয় বিলম্ব

মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পর কেন্দ্রীয় কমিটির আংশিক ঘোষণা করা হলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের। প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের হস্তক্ষেপ, জ্যেষ্ঠতা না মানা, সংস্কারপন্থিদের নেতৃত্বে আনা, অন্য দলের নেতাকে পদ দেওয়া, অফিস সহকারীকেও কমিটিতে রাখা-এসব নিয়ে সংগঠনটির ভিতরে-বাইরে ক্ষোভ বাড়ছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতে বিএনপি নেতারা ‘মাইম্যান’ রাখতে মরিয়া। এ কারণে স্বতন্ত্র সহযোগী সংগঠন হয়েও ছাত্রদলে যোগ্যরা ঠাঁই পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূলের কমিটিতে পদ-পদবি নিয়ে সংগঠনটির আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয়তাবাদী যুবদলের কমিটিতেও একই অবস্থা। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতাদের কারণে কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। বিশৃঙ্খল জাতীয়তাবাদী মহিলা দলেও। অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো শুধু নামেমাত্র। তাদের কর্মসূচি শুধুই দিবসভিত্তিক। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যেও তৃণমূলে বিএনপির অঙ্গসংগঠনে কমিটি হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমও শুরু করেছি। এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা হয়েছে। বিএনপির মতো সবচেয়ে বড় দলে নানামুখী প্রতিযোগিতা থাকবেই। কেউ কমিটিতে ঠাঁই না পেলেই সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা বলে। তারা নেতাদের নিয়েও কথা বলেন। আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এই প্রতিকূল পরিবেশেও কাজ করে যাচ্ছি। জানা যায়, সম্প্রতি ১৪৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় আংশিক কমিটি ঘোষণার পর স্বেচ্ছাসেবক দলের ভিতরে-বাইরে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। এর মধ্যে সোমবার সন্ধ্যায় আবার সহসভাপতি পদমর্যাদায় ২৭ জনকে উপদেষ্টা, স্বেচ্ছাসেবক দলের মরহুম সভাপতি শফিউল বারীর স্ত্রী বীথিকা বিনতে হোসেনকে সম্মানিত সদস্য এবং ৯ জনকে নির্বাহী সদস্য হিসেবে অনুমোদন দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অভিযোগ রয়েছে, ঘোষিত কমিটিতে বিগত স্বেচ্ছাসেবক কমিটির ত্যাগী ও সক্রিয় নেতাদের বাইরে রাখা হয়েছে। সূত্রমতে, সাবেক ছাত্রদল নেতাদের একটি অংশকেও রাখা হয়নি কমিটিতে। সিনিয়র-জুনিয়রের ক্রমধারা মানা হয়নি। লবিং-তদবিরে যারা এগিয়ে গেছেন তাদের সেভাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক দফতর সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাচ্চুকে যুগ্ম সম্পাদক করা হলেও বিগত কমিটির সহসম্পাদক এবং সদস্যদের মধ্যে অনেকে পেয়েছেন সহসভাপতির পদ। আবার বেশ কয়েকজন নিষ্ক্রিয় নেতাকে পদায়ন করা হলেও বাদ পড়েছেন গত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল হাসান পিন্টু। রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ও সংস্কারপন্থি বলে খ্যাত নরসিংদীর আহসান হাবিব প্রান্ত, জাকারিয়া আল মামুনকেও রাখা হয়েছে যুগ্ম সম্পাদক পদে। নরসিংদীর দীপক কুমার বর্মণও পেয়েছেন কেন্দ্রীয় সহসাধারণ পদ। অফিস সহকারী সাইদুর রহমান মামুন কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন। এর আগে প্রয়াত শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর ছয় সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। গত ২৮ জুলাই বাবু ক্যান্সারে মারা যান। এরপর ওই পদে সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। সংগঠনটির নিজস্ব কোনো গঠনতন্ত্র নেই। জানা যায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে শক্তিশালী করতে ১০ সাংগঠনিক বিভাগে ১১টি টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শাখা কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। তবে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘অনৈতিক লেনদেন ও পক্ষপাতিত্বের’ অভিযোগ উঠেছে। জেলা নেতা, কেন্দ্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতার পাশাপাশি বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপি নেতারাও এসব অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ত্যাগী, পরীক্ষিত ও মামলায় জর্জরিত নেতা-কর্মী অনেক জায়গায় পদ পাননি। এ নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট ও কুমিল্লা বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় টিমকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। সূত্র জানায়, কুমিল্লা ও ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগের টিম প্রধান হচ্ছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোক্তাদির হোসেন তরু। এই টিম প্রধানের বিরুদ্ধে কুমিল্লার বিভিন্ন কমিটি গঠনে অবৈধ লেনদেন ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে। যার একটি অডিও তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হলে কুমিল্লার সাংগঠনিক বিভাগের পুনর্গঠন স্থগিত করে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট বিভাগীয় টিমের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য মৌখিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রহমান আমিনকে। এ প্রসঙ্গে আমিনুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন। এ নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, কোনো বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়নি। তবে বিভাগীয় টিমের কারও কারও বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করেছি। জাতীয়তাবাদী মহিলা দল সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে গ্র“পিং ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের অনুসারীদের মধ্যে একাধিকবার মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত ৮ মার্চ নয়াপল্টনে এক অনুষ্ঠানে দুই গ্র“পের হট্টগোলের পর চরম ক্ষুব্ধ হন বিএনপি হাইকমান্ড। ওই ঘটনার পর মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না সংগঠনটি। এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খোঁজা হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব। ২০১৬ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি এবং সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৫ মাসে তারা ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৩০টির কাউন্সিল সম্পন্ন করে। যার মধ্যে ২৬টি জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেরুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর আর কাউন্সিল করতে পারেনি সংগঠনটি। ২০১৯ সালে ৪ এপ্রিল সংগঠনটির ২৬৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। জানা যায়, গত বছর ১৬ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন পালন উপলক্ষে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে পূর্ব প্রস্তুতির এক সভাকে কেন্দ্র করে প্রথমে দুই গ্র“পের মারামারি হয়। সভাপতি আফরোজা আব্বাসের সভাপতিত্বে ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হেলেন জেরিন খানের পরিচালানায় ওই সভা শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পর সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ উপস্থিত হয়ে মাইক জোর করে ছিনিয়ে নেন। তিনি আফরোজা আব্বাসের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন। এ সময় দুই গ্র“পের বেশ কয়েকজন নেত্রী আহতও হন। পরদিন আফরোজা আব্বাস আর হেলেনের পক্ষের অন্তত দেড়শ নেতা-কর্মী সুলতানার বিরুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে অনাস্থা পত্র দেন এবং তার বহিষ্কার দাবি করেন। এরপর থেকে শীর্ষ দুই নেত্রী একসঙ্গে কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। যুবদল সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটি আংশিক হলেও ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৮০টিতেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি। দুটি জেলা টাঙ্গাইল ও পঞ্চগড়ে এখনো আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে। তবে যুবদলের শীর্ষ নেতারা সারা দেশে ১১টি বিভাগীয় টিম গঠন করে দিয়েছেন। তারা প্রতিটি বিভাগের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, থানা ও পৌরসভার কমিটি গঠন করছেন। এক্ষেত্রে জেলা নেতাদের সমন্বয়ে এসব কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের হস্তক্ষেপের কারণে কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে বলে যুবদল সূত্রে জানা গেছে। যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালেও যুবদলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি এসেছে। সারা দেশে গঠিত টিম কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূলের সব কমিটি গঠন সম্ভব হবে। এরপর কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। এ দিকে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের মর্যাদায় ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের কমিটি হয়েছে। তাদের কার্যক্রমও দৃশ্যমান। এ ছাড়া বিএনপির ১১টি অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কৃষক দল, শ্রমিক দল, ওলামা দল, মৎস্যজীবী দলসহ কয়েকটির কার্যক্রম দিবসভিত্তিক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর