শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার মাছ ধরেন মানুষ মারেন

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার মাছ ধরেন মানুষ মারেন

নাটোরের লালপুর উপজেলার সাহেরা বেগম মধ্যরাতে নিজ ঘরে খুন হন। দুর্বৃত্তরা তাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করেন। তারা সাহেরার মোবাইল ফোন, গলার চেইন, কানের দুল লুটে নেন। পুলিশ সংবাদ পেয়ে যখন সাহেরার বাড়িতে অবস্থান করছিল ঠিক তখনই আরও একটি খুনের খবর পায় পুলিশ। সাহেরার বাড়ির ঠিক এক কিলোমিটার দূরে জয়ন্তীপুর গ্রামে নিজ ঘরে খুন হন অমেজান বেওয়া (৬০) নামের এক বৃদ্ধা। তাকেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছে, প্রচন্ড শব্দ পেয়ে তারা অমেজান বেওয়ার ঘরে ছুটে যান। সেখানে তার লাশ পড়েছিল। পাশেই মালামাল ভর্তি একটি শোকেস পড়া ছিল। কেউ কেউ দুই ব্যক্তিকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর দিবাগত মধ্যরাতে দুই খুনের এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে  তোলে। তারা খুনের তদন্ত করতে মাঠে নামে। তদন্তের শুরুতে পুলিশ সাহেরার মোবাইল ফোনের সন্ধান করতে থাকে। পুলিশ সাহেরার মোবাইল ফোনটি খোলা পায়। তাতে আড়ি পাতে পুলিশ। ফোনটির ব্যবহারকারীর গতিবিধির ওপর নজরদারি শুরু করে পুলিশের দল। একপর্যায়ে মোবাইল ফোনসহ রুবেল নামে এক ব্যক্তি ও তার ছেলেকে পুলিশ আটক করে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ বাবু শেখ নামে এক ব্যক্তির নাম পায়। বাবু শেখ হলেন রুবেলের ভগ্নিপতি। ১৮ অক্টোবর তাকে নাটোর রেলস্টেশন থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বাবু শেখকে পুলিশ জেরা শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে এমন তথ্যই পায়, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যে পুলিশ রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খায়। বলে কে এই লোক! একটি নয় দুটি নয়, ১০টি খুন করে ফেলেছেন! খুনের শিকার প্রত্যেকেই নারী! বেশির ভাগ খুনই আবার করেছেন রাতের বেলায়, ঠান্ডা মাথায়। এভাবে ছয় বছরে করেছেন ১০ খুন। তার শিকার হয়েছে ১ শিশু ও ৯ নারী। নিহতদের পাঁচজনকে হত্যার আগে ধর্ষণও করেছেন তিনি। এমন তথ্য যখন দিতে শুরু করেন পুলিশ তখন নড়েচড়ে বসে। পুরনো ক্লু লেস খুনের ঘটনাগুলো তখন সামনে চলে আসে। একে একে বলতে থাকেন সব খুনের ঘটনা। আত্মস্বীকৃত এই ভয়ংকর খুনির নাম বাবু শেখ ওরফে আনোয়ার হোসেন ওরফে আনার ওরফে কালু। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের জাহের আলীর ছেলে বাবু শেখ। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই খুনি ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর নাটোর জেলা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এর পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে একে একে সব খুনের কথা স্বীকার করেন তিনি। এসব খুনের দায় স্বীকার করে সম্প্রতি কয়েক দফায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বাবু শেখ। এর মধ্যে কয়েকটি খুনের ঘটনায় অন্য লোকদের আসামি করে গ্রেফতার করা হয়েছে, একজন সাজাও খাটছেন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও মামলার নথিপত্র দেখে সিরিয়াল কিলার বাবু শেখ সম্পর্কে জানা গেছে নানা তথ্য। ভয়ংকর এই সিরিয়াল কিলার গ্রামে গ্রামে মাছ ধরতেন। আর সুযোগ-সুবিধামতো গ্রামবাসীর ঘরে ঢুকে নারীদের ধর্ষণের পর খুন করে পালাতেন। তার কাছে মাছ মারার চেয়ে মানুষ মারতেই সহজ কাজ ছিল। পুলিশ জানতে পারে, মৎস্য শিকারির বেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খুনের ‘শিকার’ খুঁজতেন বাবু শেখ। কখনো একা, কখনো দু-চারজন সহযোগীকে (তার ভাষায় জাল পার্টি) সঙ্গে নিতেন। তার সঙ্গে খুনে অংশ নিয়েছেন এমন অন্তত সাতজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ তালিকায় তার একমাত্র ছেলে ও মেয়ের স্বামীও রয়েছে।

খুনের শুরু : বাবু শেখের হাতে প্রথম বলি হন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের ওসমান গনির স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৪৫)। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট রাতে বাবু শেখ তিন সঙ্গীকে নিয়ে রোকেয়ার ঘরে ঢোকেন। ওই গৃহবধূকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে যান বাবু শেখ। এ ঘটনায় নিহতের ভাই একাব্বর হোসেন বাদী হয়ে নলডাঙ্গা থানায় পরের দিন মামলা করেছিলেন। ২০১৪ সালের ৬ মে রাতে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা মোল্লাপাড়া গ্রামের আবদুর রশিদের মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মরিয়ম খাতুন ওরফে লাবণী (১৩) ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়। বাবু শেখের দেওয়া জবানবন্দিতে জানা যায়, তিনি ও তার শ্যালক রইস মই দিয়ে ওই কিশোরীর ঘরে ঢোকেন এবং দুজনেই তাকে ধর্ষণ করেন। পরে বালিশ চাপা দিয়ে লাবণীকে হত্যা করে পালান তারা। ঘটনার পরদিন মেয়েটির বাবা আবদুর রশিদ বাদী হয়ে মামলা করেন। ২০১৪ সালে লাবণীকে ধর্ষণ ও হত্যার পর পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বাবু শেখ ঢাকায় চলে যান। সেখানে তিনি চা বিক্রি শুরু করেন। তার ছিল চার স্ত্রী। ঢাকায় এক স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আবার নাটোরে ফিরেই ওই রাতেই সিংড়ার বিগলগলিয়া গ্রামের গৃহবধূ শেফালী খাতুনকে (৪৮) ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে সজীব চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। বাবু শেখের এক আত্মীয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলে। সেখানে বেড়াতে গিয়েও তিনি চুরি করার জন্য দুই নারীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ওই বছরই ৯ জুলাই রাত ১০টার দিকে জেলার সখীপুর উপজেলার হাতীবান্ধা গ্রামের বাবর আলীর স্ত্রী সমলা বেওয়াকে (৬০) একা পেয়ে তার ঘরেই হত্যা করেন বাবু শেখ। এর প্রায় দুই মাস পরে ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে মির্জাপুর উপজেলার হরতকীতলা গ্রামের কানচু খানের স্ত্রী রুপভানু বেগমকে (৬০) হত্যা করেন বাবু শেখ। সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে রুপভানুকে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে ৪৪ হাজার টাকার জিনিসপত্র চুরি করে পালান বাবু শেখ। স্থানীয় পুলিশ এ দুটি ঘটনার রহস্য আজও উদ্?ঘাটন করতে পারেনি। তবে নাটোর জেলা পুলিশের হাতে আটক হয়ে বাবু শেখ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই দুই হত্যার দায় স্বীকার করেন। পুলিশ জানায়, প্রথম দিকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাছ মেরে জীবিকা অর্জন করতেন। পরে কাজকর্ম না হওয়ায় তিনি ‘জাল পার্টি’তে যোগ দেন। জাল পার্টির লোকজন মাছ মারার উছিলায় গ্রামে গ্রামে চুরি করে বেড়ায়। চুরি করতে গিয়ে নারী ধর্ষণ ও খুনের নেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। পুলিশের জেরায় বাবু শেখ বলেন, তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সব সময় দুর্বলদের ওপর হামলা করতেন। যেসব নারী একা ঘরে ঘুমান এবং শারীরিকভাবে দুর্বল, তাদের হত্যা করে চুরি করা সহজ। তাই নারীদের খুন করতেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব নারীকে ধর্ষণও করতেন তিনি।

সর্বশেষ খবর