বিনামূল্যে টিকা পাবে সারা দেশের মানুষ। বেসরকারি হাসপাতালে বাণিজ্যিকভাবে টিকা বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাইকে তিনি বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে বিনামূল্যে টিকা পৌঁছানো আমার অঙ্গীকার ছিল, আমি তা পূরণ করব।’
এর আগে বেসরকারি হাসপাতালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান। দ্ইু ধরনের মন্তব্যে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব নাকচ করে বিনামূল্যে সারা দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সারা দেশে টিকা কার্যক্রম পরিচালনায় জোর নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
করোনা নির্মূলে শুরু হওয়া টিকা কার্যক্রম এর মধ্যেই প্রশংসা কুড়িয়েছে। শুরুতে টিকা নিয়ে নানা গুজব-অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জোয়ারে ভেস্তে গেছে সে প্রচেষ্টা। নিবন্ধনের চাপ বাড়ছে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে। টিকা কেন্দ্রে ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিচ্ছেন মানুষ। এর মধ্যেই নিবন্ধন করেছেন ২৫ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন। ২৭ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৮ জন। টিকা প্রয়োগকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে ৫৪তম স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশেই শুরু হয়েছে গণটিকা দান কর্মসূচি। গত বছর করোনা ব্যবস্থাপনার শুরুতে কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় টিকা নিয়ে শুরু থেকেই সতর্ক ছিল সরকার। এ জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকা এনে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কিনে এনে বিনামূল্যে দেশের মানুষকে দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো বেশ কিছু দিন ধরেই বাণিজ্যিকভাবে টিকা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ‘জাতীয় কভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম : বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান। বেসরকারি হাসপাতালে বিক্রির জন্য প্রাথমিকভাবে সরকারের কাছে ১০ লাখ ডোজ টিকা চান তিনি। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি খাত টিকাদান কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখানোয় আমরা আনন্দিত। এ বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।’এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে ‘সামনের কাতারের’ কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ-হাসপাতালকে ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা প্রসেস করছি। তাদের আমরা বেশি দেব না। তারা চাচ্ছেন তাই অল্প ভ্যাকসিন দেব। আমাদের তো কোটি কোটি ভ্যাকসিন দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ তো কিছুই না।’ কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে বিক্রির জন্য টিকা দেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তৈরি হয় সিদ্ধান্তহীনতা। সমাধানের খোঁজে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টাকার বিনিময়ে নয়, দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে দেওয়া হবে টিকা। তিনি বলেন, দেশের সব মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। দেশবাসীর কাছে বিনামূল্যে টিকা পৌঁছানো আমার অঙ্গীকার ছিল। আমি তা পূরণ করব। শুধু শহর নয় গ্রামাঞ্চল, জেলা, উপজেলাসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে টিকা। সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সুষ্ঠুভাবে চলবে টিকা কার্যক্রম। জানা গেছে, টিকা বিতরণ কার্যক্রম মনিটরিং করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুষ্ঠুভাবে টিকা বণ্টনে জোর দিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, গতকাল সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৫ জন। রাজধানীতে টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ৮৭০ জন। ঢাকা বিভাগে ৭০ হাজার ২৫, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ হাজার ৭৭৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৪ হাজার ৭৮৩, রাজশাহী বিভাগে ২৭ হাজার ১০৮, রংপুর বিভাগে ১৯ হাজার ৭৫৯, খুলনা বিভাগে ২৮ হাজার ৪৩৬, বরিশালে ১৩ হাজার ১৪৬ ও সিলেটে ১২ হাজার ৭২৫ জন টিকা নিয়েছেন।
টিকা কেন্দ্রগুলোয় বাড়ছে ভিড়। এ জন্য বয়সসীমা ৪০-ঊর্ধ্ব থাকবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকার দ্বিতীয় চালান খুব দ্রুতই আসবে বলে জানা গেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ যখন টিকা পায়নি তখন প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ টিকা পাচ্ছেন। এমনকি যারা সমালোচনা করতেন তারাও টিকা গ্রহণ করছেন। করোনার শুরু থেকেই টিকা নিয়ে যখন বিশ্বে আলোচনা তখন দ্রুত টিকা পেতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যোগাযোগ রাখতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিকার জন্য অর্থমন্ত্রীকে আলাদা অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমরা দ্রুত টিকা নিয়ে আসার সব ধরনের চেষ্টা করছি।’ শিশুদের টিকাদানে সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই ‘ভ্যাকসিন হিরো’ উপাধি পেয়েছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশে এসে পৌঁছায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সরকারের কেনা অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকার প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ। আগামী ছয় মাসে দেশে আসবে বাকি টিকার ডোজ। এ ছাড়া বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছে ২০ লাখ ডোজ টিকা। সারা বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ফোর্বস ম্যাগাজিনে করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের ২ শতাধিক দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।