মঙ্গলবার, ৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে সালমান এফ রহমান

জালিয়াতি বন্ধের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না

করোনা মোকাবিলায় আমাদের সফলতা বিশ্বস্বীকৃত

মানিক মুনতাসির

জালিয়াতি বন্ধের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় আমরা ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছি। এটা বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। সারা দেশে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংক কিংবা আর্থিক জালিয়াতি বন্ধের ব্যাপারে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও কেউই পারে না। তবে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমরা সে কাজটিই করছি। জালিয়াতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। এ ছাড়া যারা জালিয়াতি করছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য নতুন নতুন আইন করা হয়েছে। গত রবিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ভবনে তাঁর কার্যালয়ে ঘণ্টাব্যাপী এ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।সালমান এফ রহমান বলেন, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছে, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিচ্ছে। এরপর ভ্যাকসিন আনা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বেশ সফলতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া করোনা-পরবর্তী বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্র আমরা তৈরি করছি। বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। করোনা মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন, শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাত পরিস্থিতি, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, রেমিট্যান্স প্রবাহ, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান এলডিসি থেকে উত্তরণসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত মতামত তুলে ধরেন সালমান এফ রহমান। তাঁর সাক্ষাৎকারের পুরো অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনার দৃষ্টিতে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেমন চলছে?

সালমান এফ রহমান : আমি মনে করি আমরা এখন খুব ভালো অবস্থানে আছি। আমাদের সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আমরা করোনার ক্ষতি বেশ দ্রুতই কাটিয়ে উঠছি। আমাদের ইকোনমির রিকভারি বেশ দ্রুতই শুরু হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমরা রিকভারিতে এগিয়ে আছি। যদিও রপ্তানি খাতটাই শুধু ৭০ বা ৭৫ শতাংশ রিকভার হয়েছে। অন্যগুলোও এগোচ্ছে। এর কারণ হলো, আমাদের এখানে অর্থনীতির ক্ষতি যেমন কম হয়েছে তেমনি জনজীবনের ভোগান্তি এবং ক্ষয়ক্ষতিও তুলনামূলক কম হয়েছে। যার ফলে আমরা দ্রুত রিকভারি করতে পারছি। দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা মোকাবিলায় আমরা অনেক ভালো করেছি। যদিও ওই সময় অনেক সমালোচনা করা হয়েছিল। বিশেষ করে গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার সময়ও বলা হয়েছিল রাস্তায় লাশ পড়ে থাকবে। লাশ টানার লোক থাকবে না। তা কিন্তু হয়নি। ফলে আমরা এটাকে খুব সফলভাবে মোকাবিলা করেছি। অনেকেই বলেছিলেন, আমাদের রেমিট্যান্স কমে যাবে তাও কিন্তু হয়নি। বরং রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্র্রার রিজার্ভেও।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : করোনা মোকাবিলা ও ব্যাপকহারে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করুন।

সালমান এফ রহমান : করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো করেছে, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিচ্ছে। এখন তো আমাদের তেমন কোনো রোগীই নেই। ভ্যাকসিন জোগাড় করা থেকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে কাজটি করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রথমে তো মানুষ মনে করেছিল ভ্যাকসিন আনার ব্যাপার একটা গল্পমাত্র। আমরা কিন্তু তাকে বাস্তব করেছি। এখন মানুষ শুধু টিকা নিচ্ছে না, আমাদের প্রশংসাও করছে। বাকি প্রায় ৩ কোটি ডোজ টিকাও পর্যায়ক্রমে আসবে এবং প্রয়োগ করা হবে। এখানে আবার গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন (গাভি) দেবে ৬ কোটি ডোজ। সেটাও আসবে। আমি আশা করি, আর দু-তিন মাস পর ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ভ্যাকসিনের আওতায় নিতে আসতে পারব। ইতিমধ্যে আমরা এটাকে ৪০-এ নিয়ে এসেছি। ইউরোপ-আমেরিকায় কিন্তু এখনো ৫০-এর নিচে নামানো হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের রোগীই নেই। আমরা যে ফেজ থ্রি ট্রায়াল করব তার মতো রোগীই তো নেই। এটা ট্রায়াল করার যে প্রটোকল আছে তাও মিট করতে পারব না। কারণ এখন আমাদের রোগীই নেই। এটা ছিল একটা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। তার পরও আমরা ভালো করেছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমান বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সালমান এফ রহমান : করোনা পরিস্থিতির পর এখন কিন্তু সবাই আবার কাজ করছে। যদিও কাজকর্ম বন্ধ ছিল মাত্র অল্প দিনই। বিনিয়োগের পরিবেশ আবার উন্নত হচ্ছে। আমরা কয়েকটি জায়গায় বেশ ভালো কাজ করতে পেরেছি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সফলতা এসেছে। আমাদের রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়েছে? এখন আপনি দেখেন কোথাও বিদ্যুতের ঘাটতি আছে? কোথাও নেই। ২০০৯-এ যখন আমরা ক্ষমতায় আসি তখন কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যাটা ছিল খুবই বেশি। এখন কিন্তু সে অবস্থাটা নেই। ঢাকার বাইরেও তেমন কোনো লোডশেডিং নেই। যা আছে তা বিতরণ লাইনের সমস্যা। এরপর আসেন অবকাঠামোর উন্নয়ন। আগে এর অবস্থা ছিল করুণ। এখন বন্দরের কথা ভাবেন। সাড়ে তিন গুণ সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে বলেই তো রপ্তানি বেড়েছে। এখন যা হচ্ছে তা হলো মাতারবাড়ী। সেখানে তো ডিপ সি পোর্ট হচ্ছে। এ মাতারবাড়ী ডেভেলপ হলে গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে। এরপর পদ্মা ব্রিজ। এ নিয়েও তো কত কথা হয়েছে। এখন সেটা বাস্তব। কানেকটিভিটি ইজ ভেরি ইমপোর্ট্যান্ট। এর আগে উন্নয়নটা ছিল ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। কিন্তু এখন সেটা সারা দেশে বিস্তৃত। ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ করে দিচ্ছি। আবার মিরসরাইয়ে তো দারুণ একটা কাজ হচ্ছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ অন্য সবকিছুর ফলটা কিন্তু আমরা আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে পেয়ে যাব। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়াইফাই পাওয়া যায়। এর ফলে ফ্রিল্যান্সাররাও এগোচ্ছেন। ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। তাদের লেনদেন অনেক সহজ করা হয়েছে। এখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে এখানে অন্তত ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের আয় হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি কি মনে করেন মহামারী করোনায়ও আমরা ভালো করছি। যেখানে সারা বিশ্ব থমকে আছে সেখানেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সালমান এফ রহমান : এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কৃষি খাত। এখানে অনেক কম জমি নিয়েও আমরা যে খাদ্য উৎপাদন করছি তা রেকর্ড। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। করোনায় তো খাদ্য ঘাটতি হওয়ার কথা তা কিন্তু হয়নি। মাছ, মাংস, ফল, শাকসবজি সবই তো আমাদের নিজেদের। কৃষি খাতই আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। কৃষি খাত বহুমুখীকরণ করা হয়েছে। এজন্যই মূলত আমাদের ক্ষতিটা কম হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প খাতে সামগ্রিক পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ হয়নি। আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের এখানে যে লকডাউনটা ছিল সেটা ছিল খুবই সীমিত পরিসরে। লকডাউনের মধ্যেও আমরা অনেক কাজ করেছি। অনেক দেশে তো মানুষ ঘর থেকেই বেরোয়নি। কোনো কোনো দেশে এখনো লকডাউন চলছে। যে কারণে আমরা খুব একটা সমস্যায় পড়িনি। আরেকটা ব্যাপার হলো, গ্রামের মানুষ কিন্তু লকডাউন মানেনি। স্বল্প আয়ের মানুষও লকডাউন সেভাবে মানেনি। নিজেদের জীবিকার তাগিদে তারা কাজ করেছে। এগোলোই আমাদের এগিয়ে রেখেছে। এগুলো তো উন্নত দেশে দেখা যায়নি। আমাদের এখানে মানুষ জীবিকার তাগিদে কাজ করেছে। বের হয়েছে। এজন্য আমাদের ক্ষতিটা মেজর ছিল না। এর সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার হলো গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্তটা ছিল তা ছিল প্রধানমন্ত্রীর একটা সাহসী সিদ্ধান্ত। সেটাও আমাদের অনেক এগিয়ে নিয়েছে। এখানে আমাদের বলা হয়েছিল, রপ্তানিতে ধস নামবে কিন্তু তা কিন্তু হয়নি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার-ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কতটা সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন?

সালমান এফ রহমান : আমরা চাওয়ার আগেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার বিষয়টাও তিনিই ঠিক করে দিলেন। এটা ছিল সত্যিই একটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যা আমাদের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। এ প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নও হয়েছে। অনেক সময় মনে হয় সমস্যাটা অনেক বড় কিন্তু আসলে এত বড় নয়। শুধু সরকার কিন্তু সমাধান দিতে পারে না। তবে পলিসি সহায়তা দিতে পারে। ওই সময় তো সারা বিশ্বই বিপর্যস্ত ছিল। প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা গেলে। ইমপেরিয়াল কলেজ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তো বলেও দিয়েছিল কত কোটি মানুষ মারা যাবে। ঢাকায় লাশ টানার মানুষ থাকবে না। তা কিন্তু হয়নি। এখানে দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমটা হলো সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও সহায়তা। আরেকটা হলো আমরা সহজে হার মানি না। বাঙালি জাতি যে হার মানে না আবার আমরা প্রমাণ করেছি। এর আগে ’৭১ সালেও আমরা প্রমাণ করেছি। তবে নানা সমস্যাও ছিল। অনেকেই অনিয়ম করেছে, অসৎ লোকেরা কিছু মন্দ কাজও করেছে। কিন্তু সেটা খুব বড় স্কেলে ছিল না। এখানে প্রণোদনা প্যাকেজগুলোও ৬০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণে যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে সেগুলো সম্পর্কে বলুন।

সালমান এফ রহমান : আমি বলব এটা আমাদের থেকে যা নিয়ে যাবে তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ তৈরি করবে। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। বিউটি পারলার রয়েছে। ফলে আমরা তো বদলাচ্ছি। সেটা তো এমনি এমনি হয়নি। নিশ্চয়ই মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে। উন্নতি করছি। এগুলো সবই দৃশ্যমান। এটা ঠিক যে এলডিসি গ্র্যাজুয়েট করার ফলে আমরা কিছু সুযোগ-সুবিধা হারাব। কিন্তু নতুন কিছু সুযোগ-সুবিধাও তো আমরা পাব। এখানে অবশ্য অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, সেগুলো কিন্তু সম্ভাবনা, সুযোগও।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং ধনী-গরিবের মধ্যকার যে  বৈষম্য সেটা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সালমান এফ রহমান : এখানে অনেকেই বলেন যে, আপনাদের যে উন্নয়নটা হচ্ছে সেটা তো ধনীরা ধনীই হচ্ছে আর গরিবরা গরিবই হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম নয়। এটা ঢাকার ড্রয়িং রুমে বসে বলাটা খুব সহজ। আমরা তো গ্রামে যাই। চলেন আপনি আমার গ্রামে। এতই যদি বৈষম্য হতো সেটা তো আমরা দেখতাম। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বাড়ছে। মানুষ এখন মাছ, মাংস খাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তবে বৈষম্য যে একেবারেই নেই তা নয়। কিছুটা আছেই। সেটা উন্নত দেশেও রয়েছে। তবে হ্যাঁ, এই মহামারীর কারণে একটা শ্রেণির মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছিল, যারা ট্যুরিজম বিজনেস করত, যাদের ছোট ছোট দোকান ছিল তারা কিন্তু পথে বসে গেছে। কিন্তু সেটার জন্যও সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। অনেকেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেকে হয়তো সেটা পারেনি। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের টানা ১২ বছরের শাসনের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সালমান এফ রহমান : এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপারে হলো কোনো নেতা যদি মনে করেন তিনি মানুষের জন্য কাজ করবেন। তিনি তা পারবেন। আমাদের এখানেও তাই হচ্ছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ম্যাজিকের কথা আমি বলব না। তবে আমি বলব তিনি (প্রধানমন্ত্রী) কাজ করেন শুধুই মানুষের জন্য। জনগণের জন্য। সিঙ্গাপুরেও তো তাই হয়েছে। একটা বিষয় এখানে বলব-মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী যখন গৃহহীনদের ঘর দিতে চাইলেন তখনো কিন্তু অনেকেই হাসাহাসি করেছে। যে এটা কী বলেন? কিন্তু আজকে দেখেন। সেটা তো বাস্তবে হয়েছে। এখানে তিনি চান সব সময় দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে। সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

সালমান এফ রহমান : এখানেও একটা কথা আমি বলব-প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অর্থনীতিবিদ নন। যখন আমরা বললাম যে আমাদের ঋণের সুদহার অনেক বেশি তখন তিনি ঋণের ক্ষেত্রে ৯ এবং আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দিলেন। এটা নিয়ে তো তখন অনেকেই হাসাহাসি করেছেন। তারা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। এমনকি ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, এটা হবে না। সম্ভব নয়। কিন্তু আজকে কী হয়েছে দেখুন। বাস্তবতা তো ভিন্ন। আজকে বাস্তবায়ন হয়েছে বলেই আমাদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও খুশি। ব্যাংকাররাও খুশি। ব্যাংকেও তারল্যের ঘাটতি নেই। অনেকেই বলছিল, তোমরা কী পাগল হয়ে গেছ? এখানে মুক্তভাবে চলতে দিতে হবে। এখানে ক্যাপ বসানো হলে ব্যাংক খাত ডেস্ট্রয় হয়ে যাবে। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা বাস্তবায়ন করেন, ডেস্ট্রয় হলে সেটা আমি দেখব। ১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে তো ব্যবসা করা যায় না। কোনো দেশেই এটা নেই। ফলে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। যদিও আমি নিজেও এটা প্রথমে চাইতাম না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও চাননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা করতে হবে। ভালোমন্দ পরে দেখা যাবে। কে কী বলল সেটা আমলে নেওয়ার বিষয় নয়। এমনকি আইএমএফ কী বলল সেটাও আমি কিছু মনে করি না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

সালমান এফ রহমান : এখানে আমাদের একটা দুর্বলতা আছে সেটা হলো সুপারভিশন। এখানে সুপারভিশনটা বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো-জালিয়াতি। এই জালিয়াতি কিন্তু বিশ্বের সব দেশেই হয়। ইউরোপ, আমেরিকাতেও হয়। ভারতেও হয়। ফলে আমাদের এখানেও হচ্ছে। এটাকে কিন্তু বন্ধ করা যায় না। জালিয়াতি কেউই বন্ধ করার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। এখানে বিষয়টা হলো, নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর আমরা সে কাজটাই করছি। জালিয়াতি যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে তার জন্য আমরা আইন-কানুন বদলাচ্ছি। জালিয়াত চক্রকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। এই ধরেন হলমার্কের সবাই তো জেলে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ভারতে জালিয়াতি হচ্ছে তাই বলে কি এখানেও হতে হবে এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সালমান এফ রহমান : না না! আমি সেটা বলছি না। জালিয়াতি কোথাও কাম্য নয়। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে তো কেউই হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। দুষ্কৃতকারীরাও বসে থাকেন না। তারাও জালিয়াতির ধরন পাল্টান। ফলে এটাকে বন্ধ করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা সেটাই করছি। এ জন্য নতুন নতুন আইন করা হয়েছে। সুপারভিশনও বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশ ব্যাংকেও তো সমস্যা। তাহলে আপনি ব্যাংক জালিয়াতি কীভাবে বন্ধ করবেন?

সালমান এফ রহমান : এখানে বিষয়টা হলো অসৎ লোক যদি থাকে তাহলে তো এমন ঘটনা ঘটবেই। সেটা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, শেয়ারবাজার যেখানেই থাকুক জালিয়াতি ঘটবেই। এই অসৎ লোকদের ঠেকাতে হবে। আপনি যতই আইন করেন মার্ডার বন্ধ করতে পারবেন না। রেপ বন্ধ করতে পারবেন না। কিন্তু এটাকে কমিয়ে আনা যায়। হবে না এটা বলা যায় না। তবে যখন ঘটনা ঘটবে তখন আমরা অ্যাকশন নিতে পারি। নিচ্ছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার মূল হোতা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং পি কে হালদার দেশ থেকে কীভাবে পালাল বলে আপনি মনে করেন?

সালমান এফ রহমান : কেউ যদি পালিয়ে যেতে চায় তাকেও আটকে রাখা কঠিন। আর এখানে সবাই তো পালিয়ে যায়নি। দু-একজন পালিয়েছে বাকিদের তো ধরা আছে। তাদের বিচারও প্রক্রিয়াধীন। এভাবে ঢালাওভাবে বলা যাবে না। এগুলো দৃষ্টান্ত হতে পারে কিন্তু উদাহরণ নয়। ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত আমরা চোখ বন্ধ করে থাকব ব্যাপারটা কিন্তু এমনও নয়। আমরা তো চোখ-কান খুলে রেখেছি। আমাদের প্রত্যেকটা ঘটনা থেকে শিখতে হবে। ঘটনার সুরাহা করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সালমান এফ রহমান : এখন শেয়ারবাজার অনেক স্থিতিশীল। এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছিল না। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার শেয়ারবাজারে শতকরা ৭০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আর বাকিটা রিটেইলার। কিন্তু আমাদের এখানে ঠিক উল্টো। এখানে কিছু মার্চেন্ট ব্যাংক ছিল। আর কিছু মিউচুয়াল ফান্ড ছিল সেগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারত না। এটা কিন্তু এখন পাল্টাচ্ছে। এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমাদের শেয়ারবাজার এখন অনেক শক্তিশালী। এখানে নতুন নতুন কিছু নিয়ম-কানুন, আইনও করা হয়েছে। নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বর্পূণ। মার্কেট চলবে নিজের গতিতে। মার্কেট বাড়বে মার্কেট কমবে। কারেকশন হবে। এখানে হায় হায় করার কিছু নেই। শুধু সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে মার্কেট ম্যানুপুলেশন হচ্ছে কিনা, সেটা হলে তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মার্কেট শুধুই বাড়তে থাকবে এটা তো হয় না। কারেকশন তো হতে হবে। সেখানে ভয় পেলে চলবে না। আরেকটা ব্যাপার হলো- আমাদের যে বিনিয়োগকারীরা, তারা এখন অনেক ম্যাচুইট আচরণ করেন। আগে অনেক হুজুগে বিনিয়োগকারী ছিল এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে। মার্কেট কমলে আগে সবাই বিক্রি করত, এখন কিন্তু তা করে না। এখন পর্যবেক্ষণ করে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আয় বাড়ছে না-এ বিষয় আপনার মন্তব্য কী?

সালমান এফ রহমান : এখানে বিষয়টা হলো-যারা ট্যাক্স দেন তারাই দেন। আর যারা দেন না, দেনই না। এ অবস্থা থেকে বেরোতে হবে। আশার কথা হলো, এনবিআর চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ৬০ হাজার নতুন করদাতা যুক্ত হয়েছেন। এটা একটা ভালো খবর। আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিওটা বাড়াতে হবে। অন্যথায় সরকারের আয় বাড়ানো যাবে না। এখানে আমাদের ট্যাক্স রেট কমাতে হবে আর ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ খবর