বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

চলে গেলেন মওদুদ আহমদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলে গেলেন মওদুদ আহমদ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি এবং বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। ব্যারিস্টার মওদুদের ব্যক্তিগত সহকারী মমিনুর রহমান সুজন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ব্যারিস্টার মওদুদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পরপরই বাংলাদেশে বিএনপির নেতা-কর্মী, বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর আইনাঙ্গনের ও রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ বিএনপি নেতা-কর্মীর অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মমিনুর রহমান সুজন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (আগামীকাল) সন্ধ্যায় স্যারের লাশ বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এরপর শুক্রবার জানাজা ও দাফনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এ বিষয়গুলো আগামীকাল (আজ) চূড়ান্ত করা হবে।’ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি প্রয়াত মওদুদ আহমদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এ ছাড়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খুব বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই। এতে শুধু বিএনপিই নয়, পুরো বাংলাদেশেরই রাজনীতি ও আইনাঙ্গনে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার মতো নয়।’ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ হ্রাস এবং বুকে ব্যথা অনুভব করলে গত বছর ২৯ ডিসেম্বর মওদুদকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের অধীনে চিকিৎসা নেন। সেখানে হার্টে ব্লক ধরা পড়ায় তাঁর হৃদ্্যন্ত্রে স্থায়ী পেসমেকার বসানো হয়। চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি সিসিইউ থেকে তাঁকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ২০ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় বাসায়। এরপর আবার ২১ জানুয়ারি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন। সেখানে দীর্ঘদিন আইসোলেশনে থাকার পর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরিস্থিতির অবনতি হলে তাঁকে একপর্যায়ে আইসিইউতে নেওয়া হয়। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী হাসনা জসিমউদ্দীন রয়েছেন। আর তাঁর মেয়ে রয়েছেন নরওয়েতে। তারও দেশে আসার কথা। শোক প্রকাশ করলেন যারা : ব্যারিস্টার মওদুদের মৃতুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মৎস ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক, উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। গভীর শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শওকত মাহমুদ, কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, রুহুল কবির রিজভী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তাবিথ আউয়াল, প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন, বজলুল করীম চৌধুরী প্রমুখ। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ।

 জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার ও মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।

লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত বলেছেন, ‘তাঁর এ মৃত্যুতে জাতি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও আইনজ্ঞকে হারাল, যা পূরণ হওয়ার নয়।’

ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা উপমহাদেশের অন্যতম আইনজ্ঞকে আমরা হারালাম। বিএনপি ও বাংলাদেশ হারাল একজন অভিভাবককে। তাঁর এ মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগতভাবে শোকগ্রস্ত।’ মওদুদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জাতি একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারাল।’

ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমি একজন আমার রাজনৈতিক ও আইনাঙ্গনের সহকর্মীকে হারালাম। এ ক্ষতি অপূরণীয়।’ সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একজন জানাশোনা ব্যারিস্টার মওদুদকে আমরা আর ফিরে পাব না। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।’

একজন মওদুদ আহমদ : ১৯৪০ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে তিনি যুক্তরাজ্যে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল ডিগ্রি নেন। পরে দেশে ফিরে যুক্ত হন আইন পেশায়। মওদুদ আহমদ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত হয়েছেন। আলোচনায় ছিলেন পুরো রাজনৈতিক জীবনে। রাজনৈতিক নানা বাঁক বদলের সাক্ষী ছিলেন এই নেতা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন আইনজীবী ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ছিলেন মওদুদ।

১৯৭৭-৭৯ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাঁকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে মওদুদ আহমদও দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং এক বছরের ভিতর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার পর বিশেষ সামরিক আদালতে ১০ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন এই রাজনীতিক। ১৯৮৫ সালে সে দন্ড মাথায় নিয়েই এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি হন মওদুদ আহমদ। এরশাদের পতনের পর ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় পার্টিতে ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া সরকারের আইনমন্ত্রী হন।

মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন। মওদুদ আহমদের স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মেয়ে। পাঁচবার মওদুদ আহমদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া বগুড়া-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর