রমজানুল মুবারকের আজ তৃতীয় দিন। রমজানের সিয়াম পালনের বিনিময়ে লোভনীয় পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র এ মাসের অনন্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন বিভিন্নভাবে। যেমন বুখারিতে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বরাতে বর্ণিত আছে, রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আদমসন্তানের প্রতিটি নেক কাজের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় রমজানে। তবে সওম বা রোজা এ থেকে ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন, সওম আমারই জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। রোজাদার আমার উদ্দেশ্যেই প্রবৃত্তি ও আহারের চাহিদা থেকে বিরত থাকে।’ যে কোনো ইবাদত ও নেক আমল কবুল এবং সওয়াবের উপযোগী হওয়ার জন্য ইমানদার হওয়া শর্ত। আল কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন নেক আমলের প্রতিদান প্রসঙ্গে ইমানের শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সুরা নাহলের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ নেক আমল করবে সে নর হোক কিংবা নারী, যদি সে ইমানদার হয় তাহলে তাকে আমি দান করব সুখময় জীবন এবং শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ আরবি ‘ইমান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ যদিও বিশ্বাস, কিন্তু প্রকৃত ইমানের মর্ম অনেক ব্যাপক ও গভীর। বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসেবে এক সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তেমনি এতটুকু জানা যথেষ্ট নয় যে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরব মরুর এক জীর্ণ কুটিরে জন্ম নিয়ে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ নামের এক মহাপুরুষ জগদ্বাসীকে শান্তি ও সৌভাগ্যের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিশ্বকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। এটুকু জানা এবং এজন্য তাঁর প্রতি অনেকের শ্রদ্ধাভাব পোষণ করাই যথেষ্ট নয়। কেননা এ ধরনের বিশ্বাস সমকালীন আরবের অনেকের মাঝেই ছিল। হিজরতের পর মদিনায় শেষ নবীর প্রতি সবচেয়ে বিদ্বেষ পোষণ করত ইহুদি ও খ্রিস্টানরা। অথচ তারাও শেষ নবীকে নিশ্চিতভাবে জানত। তাওরাত ও ইনজিলে শেষ নবীর যে বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে তা তাদের নখদর্পণে ছিল। প্রথম দর্শনেই তারা বুঝতে পেরেছিল ইনিই সেই নবী যার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন আগের সব নবী ও রসুল। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজিদেও বলা হয়েছে, ‘তারা মুহাম্মাদ (সা.)-কে চেনে যেমন চেনে নিজেদের বাপ-দাদা এবং সন্তানকে।’ এভাবে চিনতে পারার পরও তারা মোমিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কারণ ইমানের গভীর মর্মের মধ্যে নিহিত রয়েছে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মক্কার কুরাইশদের অভাব ছিল তারা জেনেবুঝেও আল্লাহর বিধান ও রসুলের আদর্শের কাছে নিজের সত্তাকে সমর্পণে প্রস্তুত ছিল না। কোনো ব্যক্তি যখন জগৎস্রষ্টা ও নিয়ন্তা একক সত্তার প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেয় এবং তাঁর বিধান ও নির্দেশের কাছে নিজের সবকিছু বিলীন করে দেওয়ার অঙ্গীকার করে, তেমনি তাঁর প্রেরিত পুরুষ বা রসুলের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনার শপথ করে তখনই সে প্রকৃত মোমিন সাব্যস্ত হয়। মোট কথা, রমজানের সিয়াম সাধনা থেকে পূর্ণমাত্রায় লাভবান হতে হলে প্রয়োজন মহামহিম রব্বুল আলামিনের প্রতি আনুগত্য ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার। নিজের চিন্তা, মনোভাব ও আচরণকে সাজাতে হয় মহান স্রষ্টার নির্দেশ ও কামনা অনুযায়ী। আর সেজন্য সহজ উপায় রসুল (সা.) প্রদর্শিত রূপরেখা অনুসরণ। মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ বোধ থাকার পাশাপাশি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞাও ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ। আল্লাহর রসুলকে যেমন জগদ্বাসীর জন্য কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হয়, তেমন আল্লাহর নির্দেশাবলি ও ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের প্রতিও আস্থা রাখতে হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর।
www.selimazadi.com