রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পাপ-কালিমাকে মুছে দেয় রোজা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

পাপ-কালিমাকে মুছে দেয় রোজা

রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত এতটাই বরকতময় যে, ‘এ মাসে পালন করা নফল কাজগুলো মহান আল্লাহর কাছে ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো সত্তর গুণ মর্যাদা পায়।’ বায়হাকি। হাদিস শরিফে নবী (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাস এলে রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, সৎ পথে চলার পথ সহজ হয়ে যায়, শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়।’ বুখারি ও মুসলিম।

নবীজি (সা.) আফসোস করেছেন তাদের জন্য যারা মোবারক রমজান মাস পেয়েও অলসতা আর উদাসীনতায় পুরোটি মাস কাটিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বৃষ্টির কথা বলা যায়। বৃষ্টির পানি অনুর্বর ভূমিতে পড়লে ভূমি তা থেকে উপকৃত হতে পারে না, কিন্তু সেই পানি উর্বর ভূমিতে পড়লেই ফসল লক লক করে বেড়ে ওঠে। তেমনি রমজান থেকে কে কতটুকু উপকৃত হবে তা নির্ভর করবে সঠিক পরিকল্পনা, কর্মপ্রচেষ্টা আর আমলের ওপর। রসুল (সা.) বলেন, ‘অনেক রোজাদার আছে যাদের ভাগ্যে ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। অনেক ইবাদতগোজার আছে সারা রাত ইবাদত যাপন করে; কিন্তু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই হয় না তার।’ মুসলিম। আল্লাহতায়ালা এ মাসে পবিত্র কোরআনুল কারিমের বিশেষ নিয়ামত দিয়ে মানবজাতিকে ধন্য করেছেন। হাদিস এবং তাফসিরের কিতাব থেকে জানা যায়, লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে সম্পূর্ণ কোরআন একবারে এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। তাছাড়া ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর সহিফাসমূহ, দাউদ (আ.)-এর ওপর যাবুর ও মুসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত এবং ঈসা (আ.)-এর ওপর ইনজিল এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। শুধুই সিয়াম সাধনাই এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব নয়; বরং এ মাসে পবিত্র  কোরআন নাজিল হওয়ার কারণেই এ মাসের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শুধু তেলাওয়াত নয় বরং কোরআনকে অর্থসহ বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কোরআনের বিধিবিধান জীবন ও সমাজে বাস্তবায়নই হবে রমজানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আল্লাহ্ বলেন, ‘রমজান সেই মাস যে মাসে মানবজাতির পথ প্রদর্শনের নিদর্শনসমূহ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কোরআন নাজিল হয়েছে। অতএব, যে এই মাস পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫। মুুমিন বান্দাদের উচিত, এ মাসে সিয়াম সাধনার পাশাপাশি নেক কাজ বাড়িয়ে দেওয়া। জানা সব পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। অজানা পাপ থেকেও আল্লাহর কাছে কায়মনে আশ্রয় চাওয়া। হালাল রুজি ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। রমজান  যেহেতু মানুষকে হারাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে, তাই এ মাসেই হালাল রুজিতে অভ্যস্ত হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সিয়াম অনর্থক কাজ থেকে বিরত রাখে, জিহ্বায় লাগাম টানে, হƒদয় পরিচ্ছন্ন রাখে, ব্যবহারকে সুন্দর করে, হিংসা-রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা দেয়। তাই বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত মানবতাকে অভিন্ন সুতোয় বেঁধে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে এ মাসে। অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যও সোচ্চার হতে হবে সায়েমকে। আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর রং ছড়িয়ে দেওয়ার দীপ্ত শপথ নিতে হবে এ মাসেই। মাহে রমজানে পুণ্যের বদলে পাপ ও বক্রতা কোনো ব্যক্তির মধ্যে বেড়ে গেলে তা অবশ্যই আত্মিক পরাজয়, যার প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য। রমজান শাসক-শাসিতে, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচুদের মাঝে সেতুবন্ধনের একটি বড় মাধ্যম। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বারণ করার এক বিরাট সুযোগ। রমজান সামাজিক, চিন্তাগত অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার একটি উপলক্ষ। মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সুবর্ণ সময় রমজান। তাই আমাদের উচিত রমজানে বেশি বেশি আত্মসমালোচনায় মনোযোগী হওয়া। তাকওয়া অর্জিত হলেই কেবল রোজা আমাদের পাপকে জ্বালিয়ে দেবে। আবারও বলছি, শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং কোরআনকে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ পড়ে আমল করা জরুরি। এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমরা কতটা মুত্তাকি হতে পেরেছি। বুঝতে পারব রোজা আসে রোজা যায়, তবুও সমাজ থেকে পাপাচার, অন্যায়, পশুত্ব, রাহাজানি কেন দূর হয় না। তাই এই রমজান হোক নিজেকে বদলে দেওয়ার, পাপ-কালিমাকে মুছে দেওয়ার, আর আল্লাহর রহমত পাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলার বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি। পীর সাহেব, আউলিয়ানগর,

www.selimazadi.com

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর