দেশজুড়ে চলছে সর্বাত্মক ‘কঠোর’ লকডাউন। এটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ মে পর্যন্ত। মানুষও ছুটছে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বিকল্প নানা পরিবহনে রাজপথ সয়লাব। যানজটের চিরচেনা রূপে রাজধানী। শপিং মল, মার্কেট, দোকানসহ বিপণিবিতানগুলোতে এখন উপচে পড়া ভিড়। অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করলেও মানছেন না সামাজিক দূরত্ব। কেউ কেউ থুঁতনিতে মাস্ক পরছেন। এখন মুভমেন্ট পাস ছাড়াই চলছে সবাই। পুলিশের তল্লাশি চৌকিগুলোতেও নেই আর নজরদারি। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য বিভিন্ন সংস্থার অভিযানগুলোও থেমে গেছে। সামনে আসছে ঈদ। মানুষ বাড়ি যাবে, আবার ফিরবে ঢাকায়। জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, চলমান নামে মাত্র লকডাউনের বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি নেই। লকডাউনের নামে মানুষের দেদার বের হওয়ার প্রবণতায় দেশজুড়ে আরও বাড়বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। তা সামলানো সরকারের কঠিন হয়ে পড়বে। অবিলম্বে কার্যকর লকডাউন বাস্তবায়নে মানুষকে অন্তত আরও কিছুদিন ঘরবন্দী করে রাখার পরামর্শও বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘সরকার যে লকডাউন দিয়েছে এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিছু খোলা থাকবে, কিছু থাকবে না- এটা লকডাউন নয়। তালা যখন মেরে দেওয়া হয়, তখন কিছু খোলা কিছু বন্ধ রাখা হয় না। ঠিক লকডাউনও তেমনই। লকডাউনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের চলাচল সীমিত করে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাংলাদেশে লকডাউনে অনেক কিছুই খোলা রাখা হয়। আবার রাস্তায় কোথাও কোথাও কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। লকডাউন ন্যূনতম দুই সপ্তাহ আর আইডিয়াল হচ্ছে তিন সপ্তাহ। লকডাউনে করোনা সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সে জন্য কোনো ধরনের শিথিলতা কাম্য নয়।’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক ডা. মুখলেসুজ্জামান হিরো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘লকাউনের মধ্যেই মানুষ চলছে, গাড়ি চলছে, দোকানপাট খোলা। এটাকে লকডাউন বলা যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। স্বাভাবিকভাবে লকডাউন হচ্ছে মানুষকে ঘরবন্দী করে রাখা। শুধু জরুরি সেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। এ জন্য ন্যূনতম তিন সপ্তাহ এভাবে চলতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এক সপ্তাহও ঠিকমতো লকডাউন কার্যকর করা যায়নি। এ ছাড়া সামনে ঈদ। মানুষ বাড়ি যাবে। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহরে ছুটবে মানুষ। এতে যেসব এলাকায় আগে সংক্রমিত হয়নি, সেসব এলাকায় মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বাড়বে। এটা ঠেকাতে হলে সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।’ সরেজমিন দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান ‘লকডাউনে’ গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সরকারি-বেসরকারি যানবাহনে সয়লাব হয়ে গেছে ঢাকার রাজপথ। ব্যক্তিগত গাড়ি, পণ্যবাহী গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশাসহ নানা পরিবহনে যানজটের চিরচেনা দৃশ্য দেখা গেছে। কঠোর লকডাউনের ১৪তম দিনে গতকাল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, শাহজাদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, বিজয়নগর, পল্টন, মগবাজার, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, সাত রাস্তার মোড়সহ বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে যানজটের পুরনো দৃশ্য। দেদার চলছে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, রিকশা, ঠেলাগাড়ি; ফুটপাথেও বেড়েছে সাধারণ মানুষের চলাচল। অনেকের মুখে নেই মাস্ক। কারও কারও মাস্ক থাকলেও ছিল থুঁতনিতে। সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না। এসবের তদারকির কেউ নেই। পুরানা পল্টন থেকে আসা শফিকুল ইসলাম নামে এক প্রাইভেটকার চালক শাহজাদপুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যানজট পেরিয়ে আমার আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। মগবাজার ফ্লাইওভার, কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে অনেকক্ষণ থেমে থাকতে হয়েছে যানজটে। লকডাউন আর স্বাভাবিক সময়ের গাড়ি চালানোর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।’
১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য ‘কঠোর লকডাউন’ জারি করে সরকার। পরে এক দফা বাড়ানোর পর আজ বুধবার রাত ১২টায় শেষ হবে। সোমবার এই বিধিনিষেধ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথাও সরকার ঘোষণা করে। লকডাউনের শুরুতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী তল্লাশি চৌকি বসানো হলেও গতকাল সেসব জায়গায় কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। পুলিশ সদস্যরা আগের মতো যানবাহন থামিয়ে ‘মুভমেন্ট পাস’ দেখছেন না।ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানালেন, রাস্তা প্রাইভেটকারে সয়লাব হয়ে গেছে। লকডাউনে এই যদি অবস্থা হয় তাহলে গণপরিবহন চালু করলে কী হবে! ঢাকার রাস্তায় এরকম যানবাহন চলতে থাকলে সরকার যত প্রচারণাই চালাক না কেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। বাড্ডায় রিকশাচালক বাশার মিয়া বললেন, ‘এত রিকশা নামছে, এত মোটরসাইকেল নামছে, আমাগো কপাল পুড়ছে। এ ছাড়া প্রচন্ড গরম আর যানজটে রিকশার চাকাও ঘুরতে চায় না।’
এদিকে দোকানপাট-শপিং মল খুলতেই রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। ঈদের বেচাকেনায় ক্রেতা-বিক্রেতার খুশিতে অবহেলায় স্বাস্থ্যবিধি। মুখে মাস্ক নেই ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই। গাদাগাদি করে মার্কেটগুলোতে দরদাম করছে মানুষ। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ, মৃত্যুহারে দেশের করোনা পরিস্থিতি নাজুক হলেও তা যেন নাড়া দিচ্ছে না সাধারণ মানুষকে। ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বিভিন্ন দোকানে ছুটছেন ক্রেতারা। গাদাগাদি করে কার আগে কে কিনবেন পছন্দের পোশাক বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী, চলছে তারই প্রতিযোগিতা। নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকান ও বিপণিবিতানে দেখা যায় বিপুল ক্রেতা সমাগম। নূরজাহান মার্কেটের গেট দিয়ে সারি সারি ঢুকছে মানুষ। সরু গলিতে গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে পার হতে হচ্ছে। বদ্ধ জায়গায় শত শত মানুষ অলিগলিতে ঘুরছে মাস্ক ছাড়া। বিক্রেতার মুখেও নেই কোনো মাস্ক। কেউ কিনছেন ফতুয়া, কেউ কিনছেন শার্ট। ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক দোকানে টানিয়ে ডাকাডাকি করছেন বিক্রেতারা। বাহারি নামের পোশাক দেখতে ও কিনতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটে এসেছিলেন ফরিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের জন্য ঈদ উপলক্ষে একটা পাঞ্জাবি কিনতে এসেছি। আবার যদি লকডাউনে মার্কেট বন্ধ করে দেয় সে আশঙ্কায় আজকেই ছেলেকে নিয়ে এলাম। করোনার ঝুঁকি আছে কিন্তু প্রয়োজনীয় সামগ্রী তো কিনতে হবে। মাস্ক পরেছি, পকেটে স্যানিটাইজার আছে।’ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে এটা ঠিক নয়। কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। আমরা পরামর্শ দিয়েছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট খুলতে। গাড়িতে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করতে বলেছি। সামনে ঈদ আসছে। আমাদের বাড়ি ফেরার বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। নইলে আমাদের সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।’