শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বাজেটে বাড়বে ঘাটতির চাপ

মানিক মুনতাসির

বাজেটে বাড়বে ঘাটতির চাপ

করোনা মহামারীর কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ছন্দপতন ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডেও এর প্রভাব পড়েছে। অর্থসংকট মেটাতে বছরের বিভিন্ন সময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য কেনাকাটাও বন্ধ রাখে সরকার। এমনকি প্রকল্পের গাড়ি কেনার প্রতিও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যার মাধ্যমে মূলত সরকার অর্থসংকট মেটানোর চেষ্টা করছে। এই অর্থসংকট সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়াচ্ছে। ফলে ঘাটতি অর্থায়ন নিয়ে চাপে পড়েছে এবং সামনের বছর এই চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্র্থবিভাগ বলছে, আসছে ২০২১-২২ বাজেটে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। যা হবে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাজেট ঘাটতি। গত এক দশক ধরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এবার তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। এর খসড়া রূপরেখাও প্রস্তুত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল এ উপলক্ষে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাও করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সে বৈঠকে উপস্থাপিত বাজেটের খসড়া রূপরেখা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে খসড়া অনুযায়ী এবারের বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৬ লাখ কোটি টাকার মতো। আর বিশাল আকারের এই বাজেটে ঘাটতিও থাকবে রেকর্ড পরিমাণ। যা ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনা মহামারীর ফলে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দাবস্থা। কাজ হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন মধ্য আয়ের মানুষ। যার ফলে আগামী বছরও সরকারের রাজস্ব আদায়ের ধারা নেতিবাচকই থাকবে বলে ধারণা করছে অর্থবিভাগ। ফলে সরকারের ঘাটতি বাজেটের অর্র্থায়ন নিয়ে চাপে থাকতে হবে সরকারকে। আর এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়াতে হবে। অবশ্য বৈদেশিক উৎস থেকেও অর্থায়ন করতে মরিয়া থাকবে সরকার।

এদিকে ঘাটতি চাপ সামাল দিতে ও খরচ কমাতে সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করে অর্থবিভাগ। সেখানে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আওতায় নতুন কোনো পূর্ত কাজের অনুমোদন দেওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে বলা হয়, চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও সরকারের কৃচ্ছ্র সাধন নীতির আলোকে চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় নতুন কোনো পূর্ত কাজের কার্যাদেশ দেওয়া যাবে না। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ এর আওতামুক্ত থাকবে।

সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ কোটি টাকার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। বাজেট প্রণয়নের কাজটি প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জিডিপির অংশ হিসেবে বাজেট ঘাটতি সাড়ে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্ততপক্ষে গত ১০ বছরের মধ্যে এত বিশাল পরিমাণ ঘাটতি নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়নি বলে জানা গেছে। এর আগে সবসময় বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখার চেষ্টা করা হতো। যা ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও (আইএমএফ) একটি গাইডলাইন। অবশ্য বিশাল পরিমাণ এই বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে। এতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে নেওয়া হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার আশা করছে সরকার। জানা গেছে, খসড়া রূপরেখা অনুযায়ী আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে ঘাটতি ছয় দশমিক এক শতাংশ, চলতি বছর বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক আট শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বাকি চার মাসে আদায় করতে হবে এক লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর মধ্যে আদৌ এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে কিনা যা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। খোদ এনবিআরের কর্মকর্তারাও বলছেন এবার বছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়াতে রেকর্ড পরিমাণ।

এক নজরে গত কয়েক বছরের ঘাটতি বাজেট : ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ওই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের বিপরীতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৬৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ওই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের জিডিপির পাঁচ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের জিডিপির চার দশমিক ছয় শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের জিডিপির পাঁচ শতাংশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজেট ঘাটতি প্রতি বছরই থাকে। কারণ আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও অনেক কম। যার ফলে রাজস্ব আদায় কম হয়। গত বছর শেষে শুরু হওয়া করোনা মহামারীর কারণে সরকারের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায়ে ছন্দপতন ঘটেছে। ফলে আগামী বছর যদি বাজেট ঘাটতি আরও বেশি হয় সেটি অস্বাভাবিক কিছু হবে না। তবে এই ঘাটতি মেটাতে সরকার যে কাজ করবে সেটি যদি এমন হয় যে, ব্যাংক খাত থেকে অনেক বেশি ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। এমনিতেই করোনার কারণে আমাদের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাতনির্ভরতা কমাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর