বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বিদেশে মাদক পাচারের রুট শাহজালাল

সাখাওয়াত কাওসার

বিদেশে মাদক পাচারের রুট শাহজালাল

আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে আরও বেপরোয়া দেশি-বিদেশি মাদক মাফিয়ারা। এক্ষেত্রে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়াদের পছন্দের তালিকায় এখনো শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে মাঝেমধ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রপ্তানি পণ্যের আড়ালে মাঝেমধ্যে মাদকের দু-একটি চালান ধরা পড়ছে। তবে কোনোভাবেই তা বন্ধ হচ্ছে না। কিছুদিন বিরতি দিয়ে ফের সক্রিয় হয়ে উঠে চোরাচালানি চক্র।

অভিযোগ রয়েছে, অসাধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট (কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) ব্যবসায়ী এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িতদের ব্যবহার করেই নির্বিঘ্নে পাচার হচ্ছে মাদকের বড় বড় চালান। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারদের কাছ থেকেও তদন্তসংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য পাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, মাদকের চোরাচালান ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রহস্যজনক নীরব রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মুহাম্মদ আহসানুল জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছুদিন আগেই মাদক পাচারে পোস্টালের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে পোস্টালের ডিজি মহোদয়কে অবহিত করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তবে শাহজালালকে যাতে কোনোভাবেই মাদকের রুট হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ডিএনসি কাজ করে যাচ্ছে। তবে এয়ারপোর্টে ডিএনসির সদস্যরা যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের বিশ্রামের জন্য একটু জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আমরা সেখানকার কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় বলেছি। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি না। 

তিনি আরও বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ডগ স্কোয়াডের বিষয়ে ভাবছি। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে চিঠিও লেখা হয়েছে। ডগ স্কোয়াডের অনুমতি পেলে মাদক নিয়ন্ত্রণে আরও ভূমিকা রাখতে পারবে ডিএনসি। আগে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস দিয়ে মাদক পাচার করা হলেও এখন সরকারি ডাক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা- এমন খবর আসছে। ডিএনসির সদস্যরাও বসে নেই।

গত বছরের নভেম্বর মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি সুরক্ষা ইউনিটের মালামাল কার্টনের অভ্যন্তর থেকে প্রায় ৩৯ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়। যা কার্গো বিমানে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনায় মামলা করা হয়। এ মামলায় ডিএনসি ইতিমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। সিন্ডিকেটটির অন্যতম মাস্টারমাইন্ডসহ আরও সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

জানা গেছে, এরপরই বিশেষভাবে আলোচনায় আসে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি। ওই সময় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি আরও ১২টি টু ডি স্ক্যানার কেনার কথা বলে। যদিও গতকাল পর্যন্ত বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় যুক্ত হয়নি এসব স্ক্যানার। তবে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি পণ্য তল্লাশি কিংবা স্ক্যানিংয়ের বিষয়ে কাস্টমস, ডাক বিভাগ, ডিএনসির ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরছে। গতকাল সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল-আহসানও একই বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ফ্লাইটে কোনো ধরনের থ্রেট আছে কিনা তাই মূলত দেখভাল করার দায়িত্ব আমাদের। কার্গোতে কী রয়েছে তা দেখার জন্য বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। তবে আমরা ১২টি টু ডি স্ক্যানার কিনছি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার ৩০০টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা দেওয়ার কথা রয়েছে। এসব ক্যামেরা সংযোজিত হলে নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।

এদিকে গত ১৯ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের একটি ব্যাগে ২ হাজার ৩৫৫ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ডাক বিভাগের চার কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, বিমানবন্দরের ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে পোস্ট অফিসের মালামাল স্ক্যানিংকালে একটি ব্যাগের ভিতর ইয়াবাগুলো পাওয়া যায়। অন্যদিকে গত ২২ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনাল থেকে তেঁতুলের আচারের দুটি বয়ামে ৯ হাজার ৮৮৫ পিস ইয়াবাসহ এক যাত্রীকে আটক করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ। রাকিব হোসেন নামে ওই যাত্রীর গালফ এয়ারের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে বাহরাইন হয়ে সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পেটের মধ্যে বিশেষ কায়দায় ৭ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবাসহ মো. সফিকুল আলম (৪২) ও  মো. শাহজাহান মিয়া (২১) নামে দুজনকে গ্রেফতার করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এপিবিএন)। গ্রেফতার দুজন কক্সবাজার থেকে নভোএয়ারের ফ্লাইটে ঢাকা এসেছিলেন। তবে বিমানবন্দরের স্ক্যানিংয়ে তারা ধরা পড়েননি। তবে এপিবিএনের সদস্যদের জেরার মুখে পেটের ভিতর ইয়াবা থাকার কথা স্বীকার করেন। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর তাদের পেট থেকে ১৬০ প্যাকেট ইয়াবা বের করে আনা হয়। তাদের কাছ থেকে ৭ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত ৩০ জানুয়ারি কক্সবাজার থেকে পাকস্থলীতে করে ২ হাজার ৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আনার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ব্যক্তিকে আটক করে আর্মড পুলিশ। এ সময় আটক গোলাম মোস্তফা মন্ডলের সহযোগী মোহাম্মদ আলীকেও আটক করা হয়। গত ২০১৯ সালের নভেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সিডোঅ্যাফিড্রিন পাঠানো হচ্ছিল। চালানটি মালয়েশিয়ায় ধরা পড়ে। অপর দুটি চালানের একটি হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাম্ফিটামিন যাচ্ছিল। ইয়াবা যাচ্ছিল সৌদি আরবে। সবকটিই  তৈরি পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে মাদক পাচারের চেষ্টা করা হয়েছিল।  গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা ইয়াবা তৈরির উপকরণ অ্যাম্ফিটামিন উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা। তিনি জানান, তৈরি পোশাক পণ্যের আড়ালে ১২  কেজি ৩২০ গ্রাম সাদা রঙের অ্যাম্ফিটামিন পাচারের চেষ্টা করেছিল পাচারকারীরা। এই মামলাটির তদারকির দায়িত্বে থাকা একাধিক ডিএনসি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাচারকারীরা বাংলাদেশি ও ভারতীয়। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুনায়েদ জানিয়েছেন, তিনি একসময় আবুধাবিতে শ্বশুরের আবাসন ব্যবসার দেখাশোনা করতেন।

সেখানেই চেন্নাইভিত্তিক ব্যবসায়ী সীতেশের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালের দিকে তিনি ও সীতেশ অ্যাম্ফিটামিন পাচার শুরু করেন। তারা মিটফোর্ডে বান্টি নামের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে কলকাতা থেকে নিয়মিত সিডোঅ্যাফিড্রিন ও অ্যাম্ফিটামিন আনতে থাকেন। উত্তরায় নেপচুন ফ্রেইট নামে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিংয়ের একটি অফিস নেন দুজন। মাদকের প্যাকেজিং সীতেশের তত্ত্বাবধানে হতো। সর্বশেষ যে চালানটি ধরা পড়ে, সে সময় সীতেশ ঢাকায় ছিলেন না।

পুলিশ ও ডিএনসি বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দর মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, এমন তথ্য তারা পাচ্ছেন। এর জন্য মূলত দায়ী লাগেজে পণ্য পরিবহনের সময় স্ক্যানিং ঠিকমতো না হওয়া। প্রথমে মাদক তৈরির কাঁচামাল সিডোঅ্যাফিড্রিন পাচার এবং পরে অ্যাম্ফিটামিন ও ইয়াবার চালান আটকের পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বলছে এসব কথা। মাদকের গন্তব্য প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় তিনটি চক্রকে শনাক্ত করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এসব চক্রে ৫০ থেকে ৬০ জন আছেন। নজরদারিতে রাখা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মী, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় পাসপোর্টধারী নাগরিক, নামসর্বস্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ও ভারতীয় কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতাকে।

সর্বশেষ খবর