বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বিটুমিন সিন্ডিকেটে ভয়ংকর ১৯ মাফিয়া

রুহুল আমিন রাসেল

বিটুমিন সিন্ডিকেটে ভয়ংকর ১৯ মাফিয়া

দেশে ভয়ংকর হয়ে উঠছে বিটুমিন সিন্ডিকেটের ১৯ মাফিয়া। জানা গেছে, এ চক্র মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে উৎপাদিত আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। ওই বিটুমিনে তৈরি রাস্তা ছয় মাসেই ভেঙে হয় খানখান। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও সিন্ডিকেটের লুটপাটে হয় বদনাম। কারণ বিএসটিআই, বিপিসির অনুমোদন নেয় না সিন্ডিকেট, নীরবেই খালাস দেয় কাস্টমস। এরপর চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, সীতাকুন্ড থেকে বাড়ৈয়ারহাটে সেই নিম্নমানের বিটুমিনে ড্রামে ড্রামে মেশানো হয় ভেজাল। ঠিকাদারদের কাছে কম দামে বিক্রি হয় ভেজাল বিটুমিন। এ পরিস্থিতি উত্তরণে বিটুমিন মাফিয়াদের বিরুদ্ধে বিইআরসির কঠোর অ্যাকশন দেখতে চান অংশীজনেরা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের থেকে সস্তা দামে বিটুমিন আমদানি করা হচ্ছে। অসাধু ঠিকাদাররাও নিম্নমানের এ বিটুমিন লুফে নিচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।’

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসির সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘আমরা আমদানি হওয়া বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণ করি। এতে নিম্নমান ও ভেজাল মেশানোর অভিযোগ পেলে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বা ইআরএল উৎপাদিত বিশ্বমানের বিটুমিনের বদলে আমদানি হওয়া নিম্নমানের ও ভেজাল বিটুমিন সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে বন্দরনগর চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ভয়ংকর বিটুমিন সিন্ডিকেট। এ মাফিয়া চক্রের প্রতিষ্ঠানগুলোই পুরো বিটুমিন খাত নিয়ন্ত্রণ করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমদানি করা বিটুমিনের গুণাগুণের কোনো তথ্যই মাফিয়া চক্র কোথাও উল্লেখ করে না। ফলে বিটুমিনের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার আমদানি হওয়া বিটুমিন বিএসটিআই, বিপিসি ও অন্য কোনো সংস্থারই অনুমোদন নেয় না। কাস্টমসও কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এসব বিটুমিন খালাস করছে। ফলত প্রায় ৫০ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতবদল হয়। এর পরই চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থেকে বাড়ৈয়ারহাট- এ এলাকায় ৮ থেকে ১০টি মিলে বিটুমিনের ড্রামে ভেজাল মেশানো হয়। ফেনী থেকে মিরসরাইতে কয়েকটি স্থানে বিটুমিনে ভেজাল মেশানো হয় প্রকাশ্যে। এসব মিলে বিটুমিনের সঙ্গে মাটি, বালু মিশিয়ে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে এতে তৈরি রাস্তা এক থেকে ছয় মাসেই ভাঙছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আমদানি হওয়া বিটুমিন জাহাজে তোলার সময় প্রথমে হিট দেওয়া (তপ্ত করা) হয়। এতে বিটুমিনের মানের ক্ষতি হয়। জাহাজ থেকে নামানোর সময় আরেকবার হিট দেওয়া হয়। তখন বিটুমিনের আবার ক্ষতি হয়। ড্রামে ভরার সময় আরেকবার হিট দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এভাবে বারবার হিট দেওয়ায় বিটুমিনের শক্তি বা পেনিট্রেশন কমে যায় বা পাতলা হয়। আর পাতলা বিটুমিনের ডাকটিলিটিও স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হয়। ফলে এ বিটুমিনে তৈরি রাস্তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি-আইইউটির সহকারী অধ্যাপক বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চোরাই প্রক্রিয়ায় মানহীনভাবে তৈরি বিটুমিন বাংলাদেশে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই মানহীন ও রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকায় ভেজাল বিটুমিনের দামও কিছুটা কম হয়। যা আসলে আবর্জনা। অথচ এ বিটুমিন আমরা রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করছি!’

জানা গেছে, বিদেশ থেকে জাহাজে করে পরিবহনের সময় বিটুমিনের সঙ্গে নিম্নমানের অবশিষ্টাংশ বা কাদা, পানি ও অন্য দূষিত পদার্থ মিশ্রিত হয়। সমুদ্রযাত্রার কালে দীর্ঘ সময় ধরে তাপে থাকায় বিটুমিনের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো বদলে যায়। যে সময় পর্যন্ত একটি পণ্য ব্যবহারের উপযোগী থাকে, সে সময়কে ওই পণ্যের শেলফ লাইফ বলা হয়। শেলফ লাইফ অতিক্রান্ত হওয়ার পর পণ্যের গুণগতমান হ্রাস পায়। আমদানি করা বিটুমিনের ক্ষেত্রে আমরা এর শেলফ লাইফ সম্পর্কে জানি না। বাংলাদেশে ব্যবহৃত আমদানি করা বিটুমিন প্রস্তুতি, আমদানি ও বণ্টনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসে। সুতরাং আমদানি করা বিটুমিনের গুণমান নিশ্চিত করা যায় না। জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের যে কোনো কাজে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন কিংবা ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ বিটুমিনের প্রাপ্তি সাপেক্ষে আগে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনই ব্যবহার করতে হবে। না পাওয়া গেলে সে ক্ষেত্রে মানোত্তীর্ণ অন্য বিটুমিন ব্যবহার করা যাবে। অথচ এ জায়গায় অসাধু ঠিকাদাররা আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছেন। এসব বিটুমিনের দামেও আবার বেশ তারতম্য রয়েছে। প্রসঙ্গত, ইস্টার্ন রিফাইনারি বিটুমিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী দুই গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। এদিকে ঢালাই করার কয়েক মাসের মধ্যেই রাস্তা নষ্ট হওয়া, ঢালাই করা ওপরের অংশ উঠে যাওয়া, খানাখন্দ ও সামান্য গরমেই রাস্তা গলে যাওয়ার মতো অবস্থার জন্য বিটুমিন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী। তা ছাড়া ঢালাইকালে ব্যবহার করা পাথর, ঢালাই করার আগে ওই স্থান পরিষ্কার করা, বিটুমিনের ওপর নির্ধারিত ও সহনীয় তাপমাত্রা প্রয়োগের বিষয়গুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা। এসব বিষয় সঠিকভাবে মানা না হলে শুধু যথাযথ বিটুমিন প্রয়োগ করলেও রাস্তা কয়েক মাসের মধ্যেই বেহাল হতে বাধ্য। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে এসব বিষয় যথাযথভাবে মানতে দেখা যায় না।

ইস্টার্ন রিফাইনারির তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। চাহিদা সাড়ে ৫ লাখ টনের মতো। বাকি বিটুমিন দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য যে ক্রুড অয়েল আমদানি করে আনা হয় সে ক্রুড অয়েলে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি প্রস্তুত হয়। এসবের মধ্যে বিটুমিন উপজাত পণ্য একটি।

প্রকৌশলীদের মতে, আমাদের যে কোনো কাজে ইস্টার্ন রিফাইনারির ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে যখন ইআরএলের বিটুমিনের সংকট চলে তখন গ্রেড ঠিক রেখে অন্য বিটুমিনও ব্যবহার করা যায়। ইআরএলের সংকটের সময় কাজ তো বন্ধ রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ইআরএলের বিটুমিনের একটি ড্রাম শো হিসেবে ঢালাই করার সময় রাখা হয় অনেক ক্ষেত্রে। যাতে ইন্সপেক্টরদের দেখানো যায় পরিদর্শনের সময়।

বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিটুমিনের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা গেছে, ৮০-১০০ গ্রেডের এ বিটুমিন দেখতে কুচকুচে কালো। ফলে একশ্রেণির মৌসুমি ঠিকাদার সড়ক পিচঢালা করতে এ বিটুমিন ব্যবহার করেন। কারণ হিসেবে ঠিকাদাররা বলেছেন, দেখতে কালো হওয়ায় আপাতদৃষ্টে মনে হয় অনেক বেশি বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। তা ছাড়া দামও অনেক কম।

এদিকে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের পর দ্রুত রাস্তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির পরও তা কার্যকর করা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। যেনতেন প্রকারের বিটুমিন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। উল্টো মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ হয়ে আনা নিম্নমানের বিটুমিনের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ড্রাম ভর্তি করে এসব বিটুমিন দেশে এনে গলিয়ে বাল্কে বিক্রি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের তদারকি আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দুই জায়গায় এবং নোয়াখালীতে প্রকাশ্যে সড়কের কাছে ড্রামে করে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন গলানো হচ্ছে। বর্ষার শেষে সড়কগুলো সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমানে একযোগে কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এবং পৌর কর্তৃপক্ষ। নিম্নমানের বিটুমিন আমদানিকারকরা এ সময়টিই বেছে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের অন্য সংস্থাগুলোর তৎপর হওয়া জরুরি।

জানা গেছে, দামে সস্তা হওয়ায় অনেক ঠিকাদার এ বিটুমিন ব্যবহার করেন। নিম্নমানের বিটুমিন ধূসর রঙের হয়। এর সঙ্গে গিলসোনাইড নামের কেমিক্যাল মেশানোয় এসব বিটুমিন অতি কালো দেখায়। ফলে আপাতদৃষ্টিতে কার্পেটিংয়ের পর দেখতে অনেক ভালো মনে হয়। শুকনো মৌসুমের কিছুদিন সড়ক ভালোও থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই তা দ্রুত গাড়ির চাকার সঙ্গে উঠে গিয়ে খানাখন্দের সৃষ্টি করে। আবার অতিরিক্ত গরমে গলে গিয়েও সড়কের ওপরের কার্পেটিং এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দুই জায়গায় এবং নোয়াখালীতে প্রকাশ্যে সড়কের কাছে ইরান থেকে ড্রামে করে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন গলানো হচ্ছে। এর মধ্যে সীতাকুন্ডের ছোট কুমিরা, বার আউলিয়া এলাকায় ড্রামের বিটুমিন বাল্কে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন।

সর্বশেষ খবর