বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ওড়িশায় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস

পশ্চিমবঙ্গে একাধিক গ্রাম প্লাবিত ক্ষতিগ্রস্ত ১ কোটি মানুষ, নিহত ১

কলকাতা প্রতিনিধি

নির্ধারিত সময়ের আগেই ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ধামড়া ও বালেশ্বরের মধ্যে স্থলভাগে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। গতকাল বেলা ১২টা নাগাদ এই ঘূর্ণিঝড়ের আছড়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও এদিন সকাল ৯টা ১৫ মিনিট নাগাদ স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ে। আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গেছে, এ সময় ইয়াসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। ল্যান্ডফলের তিন ঘণ্টা পরও ধামড়া থেকে বালেশ্বরের মধ্যে ইয়াসের তান্ডব চলতে থাকে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলে ইয়াসের ল্যান্ডফল। পরবর্তী সময়ে সেই ঝড় উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খন্ড রাজ্যের দিকে এগোতে থাকে। ফলে সেখানেও উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ওড়িশা রাজ্য সরকারের বিশেষ ত্রাণ কমিশনার প্রদীপ কুমার জেনা জানান, রাজ্যের উপকূলবর্তী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাগুলো পানির তলায় চলে গেছে। একাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা বাড়ি। ঘরে থাকা পোশাক, খাবার ও জিনিসপত্র সব পানিতে তলিয়ে গেছে। যদিও কয়েক লাখ মানুষকে আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক টুইট করে জানান, যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে উদ্ধার ও পুনর্গঠনের কাজ চলছে। অন্যদিকে ভরা কাটালের সময় ইয়াসের ল্যান্ডফল হওয়ায় প্রবল জলোচ্ছ্বাসে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতেও এর ব্যপক প্রভাব পড়ে। উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘা সমুদ্র, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সন্দেশখালি, ধামাখালিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। সমুদ্র ও নদীর পানিতে গ্রামের পর গ্রাম পাব্লিত হয়ে পড়ে। উদ্ধারকাজে নামানো হয় জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ), উপকূলরক্ষী বাহিনী (কোস্টগার্ড) ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ওড়িশার বুকে ইয়াস আছড়ে পড়ার সময় কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘা সমুদ্র এলাকায়। এখানে ইয়াসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৮৮ কিলোমিটার। সমুদ্রে পানিস্তরও বেড়ে যায়। গার্ডরেল টপকে পানি চলে আসে রাস্তায়। সমুদ্র তীরবর্তী সারি সারি দোকান সব পানিতে তলিয়ে যায়। পানি ঢুকেছে প্রায় প্রতিটি হোটেলেই। হোটেলের সামনে থাকা গাড়িও ভেসে গিয়েছে পানির তোড়ে। অন্যদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দীঘার জলোচ্ছ্বাস থেকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরেন নারী সাংবাদিক সুচন্দ্রিমা, ভিডিওগ্রাফার মনোজ ও তাদের গাড়িচালক চন্দ। যদিও তাদের অফিসের গাড়িটি পানির তোড়ে ভেসে যায় এবং বেশ কিছু জিনিস নষ্ট হয়।

ইয়াসের কারণে দুই মেদিনীপুর ও দুই চব্বিশ পরগনার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলি, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, নদীয়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় মঙ্গলবার রাত থেকে কখনো ঝিরঝিরে, কখনোবা মাঝারি বৃষ্টি হতে থাকে। সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো হাওয়া। এর ফলে একাধিক জায়গায় কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ে। উপড়ে যায় গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি। বেশ কিছু জায়গা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আজও এই জেলাগুলোতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগরে কপিলমুণির আশ্রম প্লাবিত হয়ে যায়। ফ্রেজারগঞ্জেও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভেঙে পড়ে একাধিক বাড়ি। বাড়ি ছেড়ে পানির মধ্য দিয়েই হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি দেয় অসংখ্য মানুষ। ইয়াস ও ভরা কাটালের কারণে হাওড়ার বেলুড় মঠেও পানি ঢুকে পড়ে। ফলে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয় মঠে। কলকাতার প্রতাপাদিত্য রোড এবং মেডিকেল কলেজের সামনে গাছ উপড়ে পড়ে। পরে পৌর নিগমের উদ্যান বিভাগ ও এনডিআরএফের উদ্যোগে ওই গাছ সরানো হয়। ইয়াসের সতর্কবার্তা হিসেবে মা ফ্লাইওভার, তারাতলা, গার্র্ডেনরিচ, পার্ক স্ট্রিটসহ কলকাতার একাধিক উড়ালসড়কও বন্ধ রাখা হয়েছিল। যদিও দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পর বিকালে তা ফের যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বন্ধ ছিল। এদিন বিকালে রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নে সংবাদ সম্মেলন করে মমতা বলেন, ‘বাংলায় মূলত পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উপকূলবর্তী এলাকায় ঝড়ের প্রভাব পড়েছে। আজ ‘হাই টাইড’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এর জেরে যে বান আসবে তাতে পানিস্তর পাঁচ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে এবং সেই পানিস্তর আগামী দুই দিন ধরে থাকবে।’ মুখ্যমন্ত্রীর অভিমত, ভরা কাটালের জন্যই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে অনেক গ্রাম। আর এ কারণেই গতকাল রাত পর্যন্ত পানিস্তর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে রাতের দিকে ভেঙে যাওয়া বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত গোটা বিষয়টির ওপর নজরদারি চালান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। নবান্নের পাশে প্রশাসনিক ভবন উপান্নে খোলা হয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ। সেখানেই মঙ্গলবার রাত কাটান মমতা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ নিয়ন্ত্রণকক্ষেই থাকবেন। এদিনের সংবাদ সম্মেলন থেকে মমতা বলেন, ‘ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি মানুষ। ১৪ লাখের বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১৩৪টি বাঁধ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন লাখেরও বেশি বাড়ি। ১০ কোটি রুপির ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে নদীর বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আরও জোর দেওয়ার কথা জানান মমতা। এই বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন এবং গাছ লাগিয়ে বাঁধকে আরও শক্তিশালী করার কথাও বলেন তিনি। পাশাপাশি লবণাক্ত জমিতে লোনা স্বর্ণধান চাষ, লোনাপানির মাছ চাষ করার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে খাওয়ার পানি সরবরাহসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। মমতা বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে সেটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু।’ জানা গেছে, পূর্ব মেদিনীপুরের মন্দারমণিতে জলোচ্ছ্বাসের কারণে ওই যুবকের মৃত্যু হয়। সূত্র জানায়, ওই যুবকের নাম কানাই গিরি। এলাকারই আরও এক যুবক গুরুতর আহত হয়ে দীঘা রাজ্য সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে আগামী শুক্রবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন মমতা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগর, হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে দীঘায় যাবেন তিনি। সেখানে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে এদিন বিকালের দিকে কলকাতা শহরে টর্নেডোর সতর্কতা থাকলেও তা হয়নি। এ ব্যাপারে মমতা জানান, বেলা ১২টা নাগাদ শহরের আশপাশে স্থানীয়ভাবে সেই টর্নেডো হতে পারে। শহরবাসীকে এ সময় বাড়ি থেকে না বেরোনোরও পরামর্শ দেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর