পৃথিবীর ইতিহাসে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একসঙ্গে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিরল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করছেন। এর মধ্যে চলতি মুজিব বর্ষে ১০০টি মসজিদ উদ্বোধন করা হবে। প্রথম কিস্তি হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার ৫০টি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সারা দেশের ৫০টি মসজিদের এ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন তিনি। সূত্রমতে, মসজিদগুলোতে নারী ও পুরুষের জন্য অজু ও নামাজের পৃথক কক্ষ, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হেফজখানা, গণশিক্ষা কেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র, পাঠাগার, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, জানাজার ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন, অটিজম কর্নার ও ই-কর্নার থাকবে। এ ছাড়া ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর বিশেষ সুবিধা হিসেবে থাকছে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা। প্রতিটি মসজিদে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। সব মসজিদ তৈরি হলে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৪০ জন পুরুষ এবং ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ আদায়ের সুযোগ পাবেন। এসব মসজিদের লাইব্রেরিতে ৩৪ হাজার পাঠক বসে বই পড়তে পারবেন। একসঙ্গে গবেষণার সুযোগ পাবেন ৬ হাজার ৮০০ জন। দৈনিক ৫৬ হাজার মুসল্লি দাওয়াতি কার্যক্রম, প্রতিবছর ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর হেফজ পড়া, ১৬ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, ২ হাজার ২৪০ জন অতিথির আবাসনের সুবিধা থাকবে।
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ইসলামের খেদমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি ইমানদার মুসলমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দেশে ইসলামের প্রকৃত পরিচর্যাকারী। পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং হজ ভ্রমণ কর বাতিল করেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, পৃথিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামের উন্নয়ন করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকান্ডকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। স্বাধীন দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্মূলের সাফল্যও তার সরকারের বড় অবদান। বাংলাদেশকে সব ধর্মের সব মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের অনুগামী। বিশ্ব ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে তুরাগ নদের তীরবর্তী জায়গাটি প্রদান করেন। সেখানেই আজ পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা করে আসছে তাবলিগ জামাত। তাবলিগ জামাতের মারকাজ বা কেন্দ্র নামে পরিচিত কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণ করে রমনা পার্কের অনেকখানি জায়গার প্রয়োজন যখন দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় কাকরাইল মসজিদকে জমি দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করে দেন। পিতার হাত ধরেই ইসলাম প্রচার ও প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সে কারণেই তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন সারা দেশে একসঙ্গে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলামী মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং ইসলামী সাংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকার একসঙ্গে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০১৮ সালের ২৬ জুন একনেক সভায় ‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে মোট ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়। ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের আটটি বিভাগের নয়টি স্থানে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রতিটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ৪৩ শতাংশ জায়গার ওপর তিন ক্যাটাগরিতে নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে চারতলা, উপজেলা পর্যায়ে তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা (নিচতলা ফাঁকা) মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহর ও ৩টি সিটি করপোরেশনে ৫টিসহ মোট ৬৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে ৪৭৫টি এবং সি-ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেন, মসজিদগুলো সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, ধর্মীয় সভা-সেমিনার আয়োজন, হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণ, হামদ-নাত-কিরাত প্রতিযোগিতা তথা ইসলামিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম হিসেবে কাজ করবে। ইসলামী চিন্তাবিদ ও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একসঙ্গে এত মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ বিশ্বে বিরল ঘটনা। সৌদি বাদশাহরাও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। যেটা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা করলেন। এ মসজিদে যেমন নারীরা যেতে পারবেন, তেমনি ইসলামের সত্যিকারের চর্চার জন্য লাইব্রেরিতে পড়াশোনার সুযোগ থাকছে। তবে সরকারকে একটা খেয়াল রাখতে হবে, এসব মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কোনো ক্রমে যেন স্বাধীনতাবিরোধী ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতিব হওয়ার সুযোগ না পায়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, আজ উদ্বোধন করা হবে ঢাকার সাভার, ফরিদপুরের মধুখালী, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, কুলিয়ারচর, মানিকগঞ্জের শিবালয়, রাজবাড়ী সদর, শরীয়তপুর সদর, গোসাইরহাট, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, শেরপুর, কাহালু, পাবনার চাটমোহর, সিরাজগঞ্জ সদর, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, দিনাজপুরের খানসামা, বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, রংপুর সদর, পীরগঞ্জ সদর, বদরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিদপুর, জামালপুরের ইসলামপুর সদর, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, তারাকান্দা, ভোলা সদর, ঝালকাঠির রাজাপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, নবীনগর, চাঁদপুরের কচুয়া, চট্টগ্রাম জেলা সদর, লোহাগড়া, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, কুমিল্লার দাউদকান্দি, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, খুলনা জেলা সদর, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদর, কুষ্টিয়া জেলা সদর এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমা মসজিদ।