বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ সাইফুল ইসলাম নিজেকে পরিচয় দেন একজন প্রকৌশলী হিসেবে। বিদেশি কোম্পানিতে বড় পদে চাকরির কথা বললেও তিনি কাতারে শ্রমিকের কাজ করেন। মিথ্যা পরিচয়ে গত চার বছরে চিকিৎসক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ২৫ নারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।
একপর্যায়ে কৌশলে ওই নারীদের কাছ থেকে খোলামেলা ছবি নেন সাইফুল। পরে বিভিন্ন বিদেশি পর্নোসাইটে ওই ছবি প্রকাশ করেন।
২৮ জুন কাতার থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরপরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করেন। দেশে থাকার সময়ও সাইফুলের ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়েছেন কয়েকজন তরুণী। ফাঁদে ফেলে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও করেছেন। তবে প্রতারণার শিকার হয়েও মানসম্মানের ভয়ে মুখ খুলতেন না কেউ। কিন্তু গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুর থানায় এক নারী চিকিৎসকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ১৮ আগস্ট কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় আরেকটি মামলা করেন এক তরুণী। সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, সাইফুলের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জোতপাড়ায়। ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। তবে পড়ালেখা শেষ না করেই ২০১৯ সালে শ্রমিক ভিসায় কাতার চলে যান। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল তার অপকর্মের কথা স্বীকার করেছেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সাইফুল বিয়ের প্রলোভনে ২৫ জন তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে প্রতারণা করেছেন। তার মধ্যে কয়েকজনের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পর্নোসাইটেও আপলোড করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন সাইফুল। একপর্যায়ে তারা প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারলেও মানসম্মানের ভয়ে আইনের আশ্রয় নেননি। সাইফুলকে গ্রেফতারের পর বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করেন। মিরপুর থানায় নারী চিকিৎসকের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের জুনে সাইফুল অজ্ঞাত ফেসবুক আইডি থেকে তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি বার্তা পাঠান। মেসেজে সাইফুল জানান, তিনি ওই নারী চিকিৎসককে চেনেন, জানেন ও দেখেছেন। তার ছোট বোনও চিকিৎসক। তরুণীকে তিনি জানান, তিনি সুইডেনে ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র হিসেবে এমফিল করছেন। এভাবে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন সাইফুল। কয়েকবার এভাবে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলার পর সাইফুল তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নারী চিকিৎসক তাকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সাইফুল তাকে জানান, এক মাস পর দেশে ফিরে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। জুনের তৃতীয় সপ্তাহের পর তিনি ইমো অ্যাপস থেকে ওই নারী চিকিৎসককে জানান, ১২ জুলাই দেশে ফিরবেন সুইডেন থেকে। ওই দিন দুপুরে বনানীতে সাইফুলের বাসায় পরিবারকে নিয়ে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য ওই নারী চিকিৎসককে যেতে বলেন তিনি। ২০১৯ সালের ১১ জুলাই সকালে সাইফুল আবারও ইমোতে কল করে ওই নারী চিকিৎসকের দুর্বলতার সুযোগে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পাঠাতে বলেন। পরদিনই বিয়ের কথাবার্তা হবে, এমন সরল বিশ্বাসে মেয়েটি ছবি ও ভিডিও পাঠান। এরপর ১২ জুলাই সাইফুলের দেওয়া বনানীর ঠিকানায় গিয়ে তার বাসা পাননি ওই নারীর স্বজনরা। এ সময় সাইফুলের যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন সাইফুল নিজেই মেসেজ পাঠান। মেয়েটিকে জানিয়ে দেন, তিনি আর তার সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী নন। এরপর সাইফুলের ভয়ংকর চেহারা বেরিয়ে আসে। তিনি হুমকি দেন, তার কথামতো না চললে তিনি ওই নারী চিকিৎসকের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পর্নোসাইটে ভাইরাল করে দেবেন। মানসম্মান ও ক্ষতির চিন্তা করে তাৎক্ষণিকভাবে ওই নারী চিকিৎসক যোগাযোগ বন্ধ না করলেও সাইফুল সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই নারী জানতে পারেন, একাধিক মেয়ের সঙ্গে একইভাবে সাইফুল প্রতারণা করেছেন। ওই বছরের নভেম্বরে তিনি সাইফুলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। গত বছর জানুয়ারিতে একজন পরিচিত ব্যক্তি তাকে জানান, বিভিন্ন পর্নোসাইটে তার ছবি আর ভিডিও পাওয়া গেছে। কুমিল্লার ভুক্তভোগী আরেক তরুণী জানান, তাকেও বিয়ের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন তুলে সাইফুল তার ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পাঠাতে বলেন। এভাবে তাকে একাধিকবার ছবি পাঠাতে বাধ্য করেন সাইফুল। সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সাইফুলের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা ২০-২৫। তবে এখন পর্যন্ত ১০-১২ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি আরও জানান, কুমিল্লার মামলায় তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।