বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বাভাবিক ছন্দে জনজীবন

শুরু হয়েছে স্কুল-কলেজের ব্যস্ততা, রেস্টুরেন্ট ও বিনোদন কেন্দ্রে পুরনো কোলাহল, হচ্ছে বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান

জিন্নাতুন নূর

স্বাভাবিক ছন্দে জনজীবন

প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সন্তানদের নিয়ে স্কুল যাত্রার সেই চিরচেনা দৃশ্য -ফাইল ছবি

দেড় বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে জনজীবন। কেটেছে লকডাউনের শঙ্কা, কমেছে করোনাভাইরাস নিয়ে ভীতি। কমেছে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার। খুলেছে স্কুল-কলেজ। দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। চিড়িয়াখানা ও সিনেমা হলে ভিড় করছেন দর্শকরা। খুলেছে আদালতও। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেও বিয়ের আয়োজন চোখে পড়ছে। রাজধানীর শপিং মলগুলোতেও ভিড় করছে মানুষজন। সব মিলিয়ে করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার-ঘোষিত বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

তবে জীবন স্বাভাবিক গতিতে ফিরলেও মানুষের জীবনব্যবস্থায় নতুন কিছু পরিবর্তন এসেছে। মানুষজন এখন ঘরের বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন। জীবাণুনাশক স্প্রে বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছেন। সচেতনদের অনেকেই পাবলিক প্লেসে গেলে পায়ে জুতার ওপর কভার ও মাথায় ক্যাপ পরছেন। আবার জনসমাগম হয় এমন স্থান ও স্কুল-কলেজেও প্রবেশের আগে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। হাতে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে। আর নতুন এ অভ্যাসগুলো মানুষ ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ঘরের বাইরে সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি  না মানলে পরিস্থিতি আবারও খারাপ হতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও স্বাভাবিক জীবনধারায় ছন্দপতন ঘটে। এর আগে এত দীর্ঘ সময়জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না। সিনেমা হল, চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্রগুলো দেশ স্বাধীনের পর এর আগে এত দিন বন্ধ থাকেনি। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, অফিস-আদালত, কমিউনিটি সেন্টার, প্রদর্শনী কেন্দ্রও দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। কঠোর লকডাউনে আকাশ, জল ও স্থলপথেও যান চলাচল বন্ধ ছিল নির্দিষ্ট সময়। সরকারের সিদ্ধান্তে ধীরে ধীরে আবার সবকিছু সচল হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের স্কুল-কলেজ ও মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের পদচারণে আবার মুখরিত হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গন। ভোরে ইউনিফরম পরিহিত শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য আবার চোখে পড়ছে। ক্লাস শুরুর আগে এবং স্কুল ছুটির পর শিশুদের নিতে আসা অভিভাবকদের পুরনো জটলাও বলে দিচ্ছে জীবন স্বাভাবিক গতিতে ফিরছে।

মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে অবস্থিত কসমো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী আয়ান ফারুকের সঙ্গে কথা হয়। এই খুদে শিক্ষার্থী বলে, ‘অনেক দিন পর স্কুলে এসে ভালো লাগছে। যদিও আমাদের এখন সপ্তাহে এক দিন স্কুলে ক্লাস হবে। বাকি দিনগুলোতে অনলাইন ক্লাস চলবে। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে একসঙ্গে ক্লাস করতে বেশি ভালো লাগে।’ এই শিক্ষার্থীর মা নাদিয়া আবছার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ছেলে অনলাইনে ক্লাস করেছে। কিন্তু স্কুল শুরু হওয়ায় ছেলের মতো আমিও খুশি। এর ফলে আয়ান অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে পারবে, যা ওর মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন।’ করোনাভাইরাসের কারণে লোকসমাগম এড়াতে সরকার দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ রেখেছিল। সর্বশেষ আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে ১৯ আগস্ট থেকে শর্ত সাপেক্ষে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়। দীর্ঘদিন পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী এবং পর্যটন-সংশ্লিষ্ট অন্য পেশাজীবীরা সংকটে পড়েন। পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ায় নতুন করে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সরেজমিন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ঘুরে দেখা যায়, অফ সিজন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন পর পর্যটকদের জন্য সৈকত উন্মুক্ত করে দেওয়ায় মানুষ পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে দলে দলে সেখানে ঘুরতে যাচ্ছেন। পর্যটকদের পেয়ে সমুদ্র নগরীর হোটেল-মোটেলেও ফিরেছে স্বাভাবিক ব্যস্ততা। সৈকতের আশপাশে বার্মিজ মার্কেটের দোকানগুলোতেও ভালো বেচাবিক্রি চলছে। সুগন্ধা পয়েন্টে কথা হলে ঢাকা থেকে আসা পর্যটক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে কোথায় ঘুরতে যেতে পারিনি। সাগরে এসে আমাদের খুব ভালো সময় কাটছে।’

এদিকে সরকারি নির্দেশনায় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় চিড়িয়াখানা। ২৭ আগস্ট দর্শনার্থীদের জন্য মিরপুরে অবস্থিত চিড়িয়াখানাটি খুলে দেওয়া হয়। আর খুলে দেওয়ার পরপরই সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শকরা হাজির হচ্ছেন। বিশেষ করে ছোট শিশুদের পশু-পাখি নিয়ে আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। সন্তানদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘দেড় বছর বাচ্চাদের চিড়িয়ানায় যাওয়ার জেদ চেপে রাখতে হয়েছে। এখানে এসে নিজেরও ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারছি।’

এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশজুড়ে সব হোটেল-রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। ফলে আগের মতো এসব রেস্টুরেন্ট আবার জমজমাট ব্যবসা শুরু করেছে। ছুটির দিন ছাড়াও সাধারণ দিনগুলোতে বিকাল থেকে রাত অবধি গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে নগরীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে। এ ছাড়া সিনেমা হলগুলো খুলে দেওয়ায় সেখানে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভিড় বাড়ছে। রাজধানীর নতুন সিনেমা হলের তালিকায় নাম লিখিয়েছে মিরপুরের সনি স্কয়ারের স্টার সিনেপ্লেক্স। নতুন এ হলে দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখতে মানুষের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। আবার কমিউনিটি সেন্টারে সামাজিক অনুষ্ঠানের বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিয়েসহ নানা জমকালো আয়োজন।

জনস্বাস্থ্যবিদ এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মোটা দাগে এখন তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া দরকার। যতজন রোগী শনাক্ত হচ্ছে তাদের সবাইকে একটি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে। তাদের চিকিৎসা পরামর্শের মধ্যে রাখা। তারা যেন গুরুতর অসুস্থ না হন এবং অন্যদের কাছ থেকে আড়ালে থাকতে পারেন এ বিষয়ে তাদের সাহায্য করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে। কোনো কিছু স্পর্শ করলে সাবানপানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং একজনের কাছ থেকে অপরজনের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। যদি কোথাও দূরত্ব বজায় রাখতে সমস্যা হয় তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনসমাগম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কর্তৃপক্ষকেও জনসমাগম হয় এমন স্থান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রাপ্যতা সাপেক্ষে টিকা নিয়ে নিতে হবে। ভবিষ্যৎ সংক্রমণ এবং গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে এটি আমাদের রক্ষা করবে। আবার টিকা নেওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হয়েছে। এ জন্য টিকা নিয়েও অনেকে সংক্রমিত হচ্ছেন। তবে যিনি টিকা নিয়েছেন তার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু তার কাছ থেকে যিনি টিকা নেননি তার সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির যদি বয়স বেশি হয় এবং অন্যান্য রোগ থাকে তবে তার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এ জন্য টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মানুষকে অবশ্যই ঘরের বাইরে মাস্ক পরতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর