মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সবখানে সমন্বয়হীনতা

প্রশাসনের ঘাটে ঘাটে গ্যাপ, সরকার ও দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রমে আছে মতবিরোধ, উপজেলা চেয়ারম্যানদের রায় নিয়ে আলোচনা

উবায়দুল্লাহ বাদল

সবখানে সমন্বয়হীনতা

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এক যুগ হলো সরকার পরিচালনা করে আসছে দেশের বৃহত্তম এ দলটি। এই সময়ে সরকারের মধ্যে চলছে নানা ধরনের সমন্বয়হীনতা। এমনকি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও এক মন্ত্রণালয় দায়ী করছে অন্য মন্ত্রণালয়কে। এর মধ্যেই প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা ধরনের সমন্বয়হীনতা ফুটে উঠেছে। ক্ষেত্রবিশেষে ‘রুলস অব বিজনেস’ লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা মতভিন্নতা। যার কারণে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্ক ঠেকেছে তলানিতে। স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্ব›েদ্বর সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো স্থানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। এসব ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানরা বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের কাক্সিক্ষত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন না। ফলে নানা ধরনের বক্তব্যও আসছে তাদের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি ইউএনওদের মতো উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিরাপত্তা দিতে হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। আবার রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত গণমাধ্যমকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পাঁয়তারাও রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নির্বাচিত নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হলেও এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীও জানেন না বলে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন। সবকিছু মিলে সবখানে দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী নিজ নিজ কর্মপরিধির মধ্যে কাজ করার আহ্‌বান জানিয়েছেন সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যখন আইন থাকে তখন আইন অনুযায়ী কাজ করতে হয়। গণকর্মচারীদের কাজ হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের ভিতরে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। এই সমন্বয়হীনতার কারণে প্রশাসনের ভিতরে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট সরকারের উন্নয়নের সুফল ধ্বংস করছে। পাশাপাশি প্রশাসনের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে হঠাৎ করে নির্বাচিত সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করা হয়েছে। শুধু একটি পেশার নেতাদের তালিকা করে হিসাব তলব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ সমন্বয়হীনতার উদাহরণ দিয়ে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘করোনাকালের শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী নানা পেশার মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। টাকা থাকা সত্ত্বেও অক্সিজেন প্লান্ট করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা করা নিয়ে যে তুঘলকি কান্ড ঘটে গেল তা সমন্বয়হীনতার জ্বলন্ত উদাহরণ। সরকারের এক মন্ত্রী অন্য মন্ত্রীকে দায়ী করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। এসব কিছুই সমন্বয়হীনতা ও অদক্ষতা।’ তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয় আছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই দুই সত্তাকে সমন্বয় করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কারও কারও অভিযোগ, মাঠ প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর নয়। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডে সরকারকে বিব্রত হতে হয়। আর ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিতে হয় তার দায়ভার। কোথাও কোথাও স্থানীয় আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল রাখতে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং জিইয়ে রাখতেও সরকারি কর্মকর্তারা ভূমিকা রেখে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনেও সমানতালে চলছে সমন্বয়হীনতার নানা ঘটনা। সম্প্রতি ফুলগাছের পাতা খাওয়ার অভিযোগে ছাগল আটকে মালিকের অনুপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করা, নসিমন চালককে আটকে রাখা, জরুরি নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চাওয়া বৃদ্ধকে যাচাই-বাছাই না করেই বড় অঙ্কের জরিমানা করা এমন বেশকিছু ঘটনায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লকডাউনের সময় রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক ও পুলিশের বাহাস ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের হেনস্তার শিকার হওয়া ও পরবর্তী সময়ে নথি চুরির অভিযোগে মামলা দায়েরের ঘটনা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল আলোচিত। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের স্থানীয় এমপির বিরোধে জড়িয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এসব ঘটনা সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট হলেও ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে দায় নিতে হচ্ছে। সমালোচনার পুরোটাই আসছে আওয়ামী লীগের ওপর। কয়েক বছর ধরে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনপ্রশাসনের দ্ধন্ধ-সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ বরিশালে ইউএনওর বাসভবনে হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রশাসন। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে তার বিরুদ্ধে পুরো জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউএনও মো. মুনিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুটি মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বরিশালের এ ঘটনায় বিব্রত সরকার। যদিও সরকারে শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়টির আপাতত সমাধান হয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরীর দ্ধন্ধ তৈরি হয়। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার একজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমী জেরীন কান্তা। গত বছরের ৩ মে তিনি প্রতিকার চেয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখানোর পাশাপাশি সমন্বয়হীনতার অভাবেই বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সাবেক একাধিক আমলা। এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান বলেন, ‘আমি যখন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলি তখন তারা আমাকে বলেন, সম্প্রতি জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের মধ্যে এক ধরনের দ্ধন্ধ তৈরি হয়েছে। সবকিছুতেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। তবে আমার মতে, প্রশাসনের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের অবশ্যই সমন্বয় থাকতে হবে। সমন্বয়হীনতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইউএনওর সমস্যা হচ্ছে। অথচ বিদ্যমান উপজেলা আইনে যার যার কাজ সুনির্দিষ্ট করা আছে। কিছু ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে ইউএনওদের কমিটির সভাপতি করা হচ্ছে। এর ফলে তারা নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। তাই আমি বলব যখন আইন থাকে তখন আইন অনুযায়ী কাজ করতে হয়। গণকর্মচারীদের কাজ হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া।’ সাবেক সচিব ও ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন খান বলেন, ‘আইনে যার যার কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করা আছে। নিজ নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে কোনো ধরনের সমন্বহীনতা থাকার কথা নয়। উপজেলা পর্যায়ের সমস্যার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় এমপির সম্পর্ক ভালো হলে ইউএনওর কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু তাদের মধ্যে বিভেদ থাকলে ইউএনও কার পক্ষে কাজ করবেন তা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। জনপ্রতিনিধি ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, ‘সংবিধান ও আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিবিহীন কোনো প্রশাসনিক স্তর নেই। সংবিধান, আইন ও সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের প্রধান হলেন চেয়ারম্যান। সুতরাং বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কাজ করলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের মতবিরোধ হবে না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর