বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে নারী নির্যাতনের মামলায় নিম্ন আদালতে সাজার হার মাত্র ৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ১১ হাজার ২১০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ৮৪ শতাংশ মামলা থানায় ও বাকি ১৬ শতাংশ মামলা হয়েছে আদালতে। থানায় করা ৯০ শতাংশ মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। কোর্টে করা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার হার ৭১ শতাংশ। কিন্তু নিম্ন আদালতের মামলায় সাজার হার তুলনামূলক নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে নারী নির্যাতন আইনের অপব্যবহার নিয়েও। অনেকে বলছেন, প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো বা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। তদন্তের দুর্বলতার কথাও বলছেন অনেকে।
পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, নারী নির্যাতন মামলার অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপস হয়ে যায়, ফলে বিচারিক আদালতে সাজা উল্লেখযোগ্য হারে কম। তাই পুলিশ সদর দফতরের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে মামলা তদন্ত করে ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাজার হার বাড়ানোর বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় আসামিরা অনেক ক্ষেত্রে পেশিশক্তি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে মামলার তদন্ত ও বিচারে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে নারীরা ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন থাকার পরও প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে নারী নির্যাতনের ঘটনা ও মামলা বাড়ছে। কিন্তু সে হারে মামলায় সাজা হওয়ার ঘটনা বাড়ছে না। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ একটি জন্মদিনের পার্টিতে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। নিম্ন আদালত দীর্ঘ ৯৪ কার্যদিবস মামলাটির শুনানির পর ১১ নভেম্বর সব আসামিকে খালাসের রায় দেয়। এ মামলার পর নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলার বিচার পাওয়া নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ওঠে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে অপরাধ পর্যালোচনা সভায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ তিন মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫ হাজার ২৩৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণ মামলা ৫৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, অপহরণ মামলা ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ, যৌতুকের মামলা ২১ দমমিক ৭৮ শতাংশ। এ ছাড়া মোট মামলার ৮৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ মামলা হয়েছে থানায়, ১৬ দশমিক ০৩ শতাংশ মামলা হয়েছে আদালতে। থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৮৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও আদালতে করা ৭১ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ প্রায় ৯০ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করলেও নিম্ন আদালতে সাজার হার মাত্র ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একইভাবে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৯৭২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ, অপহরণ মামলা ২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যৌতুকের মামলা ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ ৮৫ দশমিক ৩৮ শতাংশের ও আদালতে করা মামলাগুলোর মধ্যে ৭০ দশমিক ৬৩ শতাংশের অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় নিম্ন আদালতে সাজার হার মাত্র ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। উচ্চ আদালতে এ হার আরও অনেক কমে যায়। একই সভায় পুলিশ দফতর ধর্ষণের মামলার আলাদা পরিসংখ্যান তুলে ধরে। এতে বলা হয়, বছরের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ৩ হাজার ৩৮৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) ২৩৮টি, নেত্রকোনায় ১৩৯টি, ময়মনসিংহে ১৭৮টি। ধর্ষণের ভিকটিমদের মধ্যে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ ছেলেশিশু, ৩০ শতাংশ মেয়েশিশু, প্রায় ৬৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর প্রায় ৩ শতাংশ ছেলেশিশু।
পুলিশ সদর দফতর নারী ও নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচলিত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি জনসাধারণকে সচেতন করার কথা বলছে। পাশাপাশি বিট পুলিশিং ব্যবস্থায় জনগণের কাছাকাছি গিয়ে তৃণমূলে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম চলমান রাখার পাশাপাশি ধর্ষণ মামলা রোধে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ধর্ষণ মামলার আলামত সংরক্ষণ ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রায় ৯০ শতাংশ মামলায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিলেও নিম্ন আদালতে সাজার হার মাত্র ৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে তদন্তের কোনো দুর্বলতা আছে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘না, তদন্তে দুর্বলতা নেই; নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার অধিকাংশই হয় পারিবারিক সহিংসতা বা যৌতুকের কারণে। বাদী-বিবাদী এক সময় আপস হয়ে যান। ফলে এসব মামলায় আদালতে সাজা হয় না। অর্থাৎ কোনো ইউনিটে মোট ৫০০ মামলা হলে ৪০০ মামলাই হয় পারিবারিক সহিংসতাজনিত কারণে, যা পরবর্তী সময়ে আপস মীমাংসা হয়ে যায়। আর ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌথ সম্মতিতে মেলামেশা হয়। পরবর্তী সময়ে মতের অমিল বা স্বার্থের সংঘাত হলে থানায় বা আদালতে গিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের মামলা করা হয়। এসব মামলায় জবরদস্তির কোনো প্রমাণ থাকে না। তদন্তে নেমে একজন তদন্ত কর্মকর্তা ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সাক্ষ্যসহ আইনি প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ প্রমাণ করতে পারেন না। ফলে এসব ক্ষেত্রে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়।’ কমিশনার আরও বলেন, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন আছে। এর পরও দেখা যায় প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে নারী নির্যাতনের মামলা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতাও জরুরি। এ ছাড়া শুধু তদন্ত কর্মকর্তার নয়, যে বাদী মামলা করেন প্রমাণের ক্ষেত্রে তারও কিছু দায়দায়িত্ব থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদী আদালতে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘নারী নির্যাতনের মামলায় একজন ভিকটিমকে সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশিশক্তি ও আর্থিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়। একজন নারী ধর্ষিত হওয়ার পর আবার ফরেনসিক পরীক্ষা, এফআইআর করা, তদন্তের সময় তাকে আবার নানমুখী তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাকে কঠোর জেরা করে। এর মাধ্যমে পদে পদে তাকে অপদস্থ হতে হয়। তদন্ত ও বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়তে হয়। এটা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখি প্রভাবশালীরা আদালতে বাদীপক্ষের আইনজীবীকেও কিনে ফেলেন।’
সালমা আলী বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো ভিকটিম মামলা করার আগে ১০ বার চিন্তা করেন কেস করবেন কি না। তার পরিবার, সমাজ ও আশপাশের কেউ তাকে মামলা করার বিষয়ে উৎসাহ দেয় না। বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফরেনসিক পরীক্ষা, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন ও পাবলিক প্রসিকিউটরের ভূমিকা মামলা প্রমাণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। এই তিনের সমন্বয়ে একটি মামলা প্রমাণ হয়। কিন্তু আমরা যতই মুখে বলি, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের আদালত এখনো নারীবান্ধব নয়। আদালতকে নানামুখী চাপ নিতে হয়। আদালতের বিচারকদের সেই ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে তাদের জানা, আন্তর্জাতিক যেসব জাজমেন্ট হয় সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ জায়গাগুলো নজরদারিতে আনাও জরুরি।’ তিনি বলেন, “নারী সুরক্ষার জন্য উচ্চ আদালতে ভালো অনেক জাজমেন্ট আছে। কিন্তু আমরা রেইনট্রি হোটেলের মামলার রায়ের ক্ষেত্রে দেখলাম কোর্ট ‘৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণ মামলা করতে হবে’ বলে হুট একটি মতামত দিয়ে বসলেন, যা তার মতো একজন বিচারকের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমার মতে, এটা ওই বিচারকের নিজস্ব মতামত। এর থেকে সমাজে ভুল বার্তা যাবে। তিনি এ ধরনের মতামত দিতে পারেন না। এর থেকে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নেবে। নারী নির্যাতন মামলায় সাজার হার বাড়াতে সাক্ষী সুরক্ষা ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ভিকটিমের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। সাউথ এশিয়াতে অনেক ভালো ভালো জাজমেন্ট আছে। আমাদের হাই কোর্টেও ভালো ভালো কিছু জাজমেন্ট আছে। আমাদের বিচারকদেরও সেগুলো অনুসরণ করা জরুরি।’