সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পাকিস্তানি সেনারা প্রাণভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালায়

মানিকগঞ্জ, বগুড়া, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ ও পিরোজপুর প্রতিনিধি

পাকিস্তানি সেনারা প্রাণভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালায়

আজ ১৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে মানিকগঞ্জ, বগুড়া, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ ও পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয় আকাশ-বাতাস।

মানিকগঞ্জ : আজ মানিকগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ পাক হানাদারমুক্ত হয়। এদিন বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে সমবেত হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর আগে টানা আক্রমণে থানাগুলো থেকে সরে এসে মহকুমা শহরে অবস্থান নিয়েছিল পাক হানাদাররা। মানিকগঞ্জ সিঅ্যান্ডবির ডাকবাংলো ছিল পাক হানাদার বাহিনীর সদর দফতর। এখান থেকেই হানাদার এবং তাদের দোসররা নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করত। আর মূল ব্যারাক ছিল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পিটিআইয়ের মূল ভবনে। মানিকগঞ্জে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে একজন কর্নেলসহ পাকবাহিনীর ৮১ সদস্য মারা যান। মানিকগঞ্জের বিভিন্ন যুদ্ধে ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নয়জন মুক্তিসেনা পঙ্গু হন। চারজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পান।

বগুড়া : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শহর হানাদারমুক্ত হয়। ১০ ডিসেম্বর থেকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাঁড়াশি হামলা শুরু করে। আকাশে মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান, মাটিতে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অভিযানে দিশাহারা পাক হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ২ ডিসেম্বর সারিয়াকান্দি থানা প্রথম হানাদারমুক্ত হওয়ার পর একে একে বগুড়ার সোনাতলা, গাবতলী, ধুনট, শেরপুর হানাদারমুক্ত হয়। ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া সদর, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া থানায় পাক বাহিনীর পতন ঘটে। মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবদুল মোত্তালিব মানিক বলেন, আসলে ৮ ডিসেম্বর বিজয় এসেছে বগুড়ায়। কিন্তু অফিশিয়ালি ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া মুক্ত ঘোষণা হয়।

নীলফামারী : ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সফল আক্রমণে হানামুক্ত হয় নীলফামারী। এদিন ভোরে জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বিজয়ের উল্লাসে মুখরিত হয়ে ওঠে সে সময়ের মহকুমা শহর। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে রাস্তায় নেমে আসেন মুক্তিকামী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জানান, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে শহরের চারদিক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে শহর ছেড়ে আশ্রয় নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী মানুষের বিজয় উল্লাসের ঢল নামে শহরে। আর সে ঢল চলে দিনব্যাপী। নয় মাসের গেরিলা আক্রমণ আর সম্মুখ যুদ্ধে জেলার ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ উপজেলা মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসেন নীলফামারী শহরের দিকে। ১৩ ডিসেম্বর ভোরে হানাদার মুক্ত হয় নীলফামারী।

বগুড়া : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় বগুড়া শহর। তিন দিন যুদ্ধের পর শহরের বৃন্দাবনপাড়া এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১০ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউনটেন্ট রেজিমেন্টের ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ নয়জন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে শহর থেকে ৩ মাইল উত্তরে চাঁদপুর, নওদাপাড়া এবং ঠেঙ্গামারা গ্রামের মধ্যবর্তী লাঠিগ্রামের কাছে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে অবস্থান নেন। সেখানে তিন দিন ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধের পর মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি ডিভিশন ট্যাংক নিয়ে শহরে ঢোকে। ১৩ ডিসেম্বর কাহালু উপজেলা ও নন্দীগ্রামও হানাদারমুক্ত হয়।

সিরাজগঞ্জ : আজ ১৩ ডিসেম্বর উল্লাপাড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনী উল্লাপাড়ায় ত্রিমুখী আক্রমণ করলে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্প হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও আবদুর রহমানের পাট গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। সকাল ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আজ লালপুরও হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় লালপুরের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিকাণ্ড ও লুটতরাজ চালায়। ১৩ ডিসেম্বর পাকসেনারা ঝটিকা আক্রমণ করে মহেশপুর গ্রামে ৩৬ জনকে গুলি করে পালিয়ে গেলে হানাদারমুক্ত হয় লালপুর।

পিরোজপুর : ১৯৭১ সালের এই দিনে হানানাদারমুক্ত হয় পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া। এই দিনে ভাণ্ডারিয়ার সব মুক্তিযোদ্ধা শহরে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা-জনতা মিলে জয় বাংলা ধ্বনিতে বিজয় মিছিল করে উল্লাস প্রকাশ করেন। আজও ভাণ্ডারিয়ার দুটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বা কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

সর্বশেষ খবর