শনিবার, ১ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ভোটের পাল্টাপাল্টিতে নারায়ণগঞ্জ

প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক, দুই মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ পরস্পরের বিরুদ্ধে

গোলাম রাব্বানী, রোমান চৌধুরী সুমন ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

ভোটের পাল্টাপাল্টিতে নারায়ণগঞ্জ

প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকার -রোহেত রাজীব

সিটি ভোটের প্রচারে সরগরম নারায়ণগঞ্জ। প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে বন্দরনগরীর পাড়া-মহল্লা। সিটিজুড়েই বইছে নির্বাচনী আমেজ। চায়ের দোকান থেকে রাজনীতির অন্দরমহল, সবখানেই ভোটের আলোচনা। ভোট চাইতে বাড়ি বাড়ি ছুটছেন প্রার্থীরা। দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। লিফলেট বিলিসহ করছেন গণসংযোগ, পথসভা ও উঠান বৈঠক। তবে নির্বাচনী আচরণবিধি তোয়াক্কা করছেন না প্রার্থীরা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক দেখা গেছে এ সিটি নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনও যেন আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয় দেখেও না দেখার ভান করছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি ভোটে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছেন প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী (আওয়ামী লীগ) ও অ্যাডভোটেক তৈমূর আলম খন্দকার (স্বতন্ত্র)। তারা গতকাল নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে জনসংযোগকালে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা রকম মন্তব্য করেন। তৈমূর অভিযোগ করেন আইভী মেয়র থাকাকালে নাসিকে গড়ে ওঠা ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের কারণে উন্নয়ন কাজ আশানুরূপ গতি পায়নি। আইভী সিদ্ধিরগঞ্জে জনসংযোগকালে গতকাল বলেন, তৈমূর কাকা মনে হয় কারও শিখিয়ে দেওয়া কথাবার্তা উচ্চারণ করছেন। তিনি না জেনে অসত্য সব অভিযোগ তুলছেন। এ রকম করা ঠিক না। তৈমূর বলেন, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে মেতে আছেন। তিনি বলেন, গণজোয়ার তৈরি হচ্ছে। গণজোয়ারের সামনে কোনো বিভ্রান্তি টেকে না। নাসিক নির্বাচনেও টিকবে না।  আইভী বলেন, গণজোয়ার তার পক্ষেই আছে। কারণ তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনে বদ্ধপরিকর।   

ব্যানার পোস্টারের শহর নারায়ণগঞ্জ : পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকার শহর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জের ২৭টি ওয়ার্ডের পাড়া-মহল্লার অলিগলি। পুরো নাসিকে যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাঁটানো ব্যানার পোস্টারের হিড়িকে চোখ তুলে ওপরে তাকালে দেখা যাচ্ছে না আকাশ। সাতজন মেয়র প্রার্থী ও ১৮২ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর হাজার হাজার পোস্টার শোভা পাচ্ছে পুরো নাসিকে। প্রার্থীদের পোস্টার লাগানোর প্রতিযোগিতা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, এক ফিট দূরত্ব বা কোথাও অনেকটা গা ঘেঁষেই আছে এক প্রার্থীর সঙ্গে অপর প্রার্থীর পোস্টার ও ব্যানার। শহরের আমলাপাড়া কালীবাজার, চাষাঢ়া মর্গ্যান গার্লস স্কুল, মাসদাইর গলাচিপা, দিগুবাবুর বাজার, মিশনপাড়া, খানপুর অক্টোফিস, জামতলা ধোপাপট্টি সর্বত্র দেখা যায় পোস্টার ফেস্টুনের এই চিত্র। এ ছাড়া ভোট নিয়ে চলছে ভোটারদের মধ্যে নানা আলোচনা। নাসিক এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে থাকা নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে বাসস্ট্যান্ড, নদীর ঘাট, রেলস্টেশন সর্বত্র একই আলোচনা নাসিক নির্বাচন।

সুষ্ঠু ভোট চান সবাই : শীতলক্ষ্যা নদীর হাজীগঞ্জ গুদারাঘাট এলাকার নৌকার মাঝি হেলাল মিয়া জানান, ৩০ বছর ধরে এখানে নৌকা চালান তিনি। নৌকায় নদী পার হওয়া সবার মুখে শুধু তৈমূর আর আইভীর আলোচনা। কে হারবে কে জিতবেন, এ নিয়েই যাত্রীরা আলোচনা করেন। শহরের চাষাঢ়া রেলস্টেশনের মুদি দোকানি রফিক মিয়া জানান, দোকানে ক্রেতাদের মধ্যে শুধু একটাই আলোচনা কে হবেন মেয়র। শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড ফতুল্লার মাসদাইর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল-সংলগ্ন চায়ের দোকান মালিক শাহাবুদ্দিন জানান, আগে দেখব ভোট দেওয়ার পরিবেশ আছে কি না। ভোট যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলেই যাব কেন্দ্রে ভোট দিতে। আর যদি না হয় তবে কষ্ট করে ভোট দিতে যাব না। ১২ নম্বর ওয়ার্ড মিশনপাড়া এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাছান বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ভোট চাই। তবে অনেকের প্রার্থী হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। এবার তারাও দাঁড়িয়েছে। তবে সুযোগ পেলে যারা শহরের শান্তি বজায় রাখবে তাদের ভোট দেব।

ভোটের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি হাজি নূরুদ্দিন জানান, আমরা চাই একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নারায়ণগঞ্জে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। কোনো সংঘাত চাই না। এটাই আমাদের কাম্য। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে  একটি ভালো ফলাফল দেখতে চাই।

তিনি বলেন, আপাতত নাসিক নির্বাচনে মেয়র দুজন প্রার্থীকেই সবচেয়ে বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখছি। এদের মধ্যে সাবেক মেয়র আইভী দীর্ঘদিন মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ। এ ছাড়া তৈমূর বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। সাধারণ মানুষের সংগঠনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। দুজনেরই ভালো ইমেজ রয়েছে। তাদের দুজনের রাজনীতিতে কোনো হানাহানি বা সংঘাত নেই। বর্তমানে কার অবস্থা কী তা বুঝতে সময় লাগবে।

নির্বাচনে সাত মেয়র প্রার্থী : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) তৃতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ ভোটের লড়াইয়ে তিনি আছেন দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। তার প্রতীক হাতি। নির্বাচনে আইভী-তৈমূর ছাড়াও মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ্ (হাতপাখা), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি), খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়াল ঘড়ি), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জসীমউদ্দীন (বটগাছ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কামরুল ইসলাম বাবু ‘ঘোড়া’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদিকে গতকাল এ নির্বাচনে মেয়র পদে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি, বন্দর শাখা। ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এবার নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ ও নারী সংরক্ষিতসহ ১৮২ জন কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। এ সিটিতে সর্বমোট ভোটার ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬২ জন।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ফ্রি স্টাইলে চলছে আচরণবিধি লঙ্ঘন। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না কাউন্সিলর প্রার্থীরা। প্রার্থীদের গণসংযোগ থেকে পোস্টারিং কিংবা মাইকিং সব ক্ষেত্রেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্টরা যেন এক রকম নির্বিকার। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল বিকাল ৫টার দিকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গোদনাইল  ধনকুন্ডা, কামাল সাহেবের বাড়ি, ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী, তাতখানা, ভুইয়াপাড়া এলাকায় শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে এক কাউন্সিলর প্রার্থী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মিছিল করেন। বিকাল ৩টার দিকে নাসিক ১ নম্বর ওয়ার্ডে তারা মার্কেট, সিআইখোলা, হিরাঝিল, পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে মিছিল করে। নাসিক ২ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি দক্ষিণ, মিজমিজি কান্দাপাড়া, রহিম মার্কেট, মৌচাক ও চৌধুরীপাড়া এলাকায় মিছিল করে অপর এক কাউন্সিলর প্রার্থী। এ ছাড়াও নাসিকের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আটি ওয়াবদা কলোনি একালায় শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে মিছিল বের করেন এক কাউন্সিলর প্রার্থী। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালন ভালোভাবেই হচ্ছে। তবুও কিছু জায়গায় লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

উজ্জীবিত সিদ্ধিরগঞ্জের কাউন্সিলর প্রার্থীরা : প্রতীক পেয়ে উজ্জীবিত সিদ্ধিরগঞ্জের কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তাদের জমজমাট প্রচারণায় উৎসবের আমেজ বইছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে। ২৮ ডিসেম্বর কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ায় তাদের অনেক উৎফুল্ল দেখা গেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ডের অবস্থান সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায়। এ ১০টি ওয়ার্ডের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গণসংযোগ চালাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর