মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণে আদালত

সিনহা হত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় পাঠের সময় আদালতের বিচারক তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ড। প্রদীপ ও লিয়াকত মূল পরিকল্পনাকারী এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। গতকাল বেলা ২টার দিকে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। বেলা ২টা ১৬ মিনিটে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি পুরো মামলায় আসামি, বাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্যে উঠে আসা ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। আসামি প্রদীপ, লিয়াকতসহ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কার কী অপরাধ বিস্তারিত তুলে ধরেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রায় ঘোষণা করেন বিচারক। এতে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এপিবিএনের তিন সদস্যসহ সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে ছয়জনকে। রায় শোনার পর খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা এজলাসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে নির্বিকার ছিলেন প্রদীপ ও লিয়াকত। কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশন) সেলিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে পুলিশ ও তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। হত্যা ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানা অপচেষ্টা চালানো হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে জড়িতদের নাম এবং তাদের নৃশংসতার কাহিনি।

রায় ঘোষণার আগে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। অন্যদিকে বিবাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বাদীপক্ষ।’ তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। জানা গেছে, মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। এর মধ্যে ৬৫ জন ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দেন।

এদিকে একাধিক মানবাধিকার ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার আগের ছয় মাসে অন্তত ১৭১টি বন্দুকযুুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে অবিশ্বাস্যভাবে বন্দুকযুদ্ধ কমে আসে পরবর্তী পাঁচ মাসে। এ পাঁচ মাসে মাত্র পাঁচটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার জন্ম দেন। এতে মারা গেছেন ২০৪ জন। এসব ঘটনাকে দেওয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে, ক্রসফায়ারে নিহতের বেশির ভাগই ছিলেন নিরীহ। এমনই একটি সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ছিল সিনহা হত্যাকাণ্ড।

তারা বলেন, অধস্তনদের ওপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি কম থাকার কারণেই প্রদীপ গং এ ধরনের ঘৃণিত অপরাধ ঘটানোর সাহস পেয়েছেন। অতীতেও হয়তো তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন তবে এমনভাবে তা গণমাধ্যমে উঠে আসেনি এবং আলোচিত হয়নি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের আজকের (সোমবার) এ রায় যুগান্তকারী। এ রায়ে মানবতা ও আইনের শাসনের জয় হয়েছে। আমরা আশা করি এভাবে প্রতিটি অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এতে সমাজে অন্যায়-অবিচার অনেক কমে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারাই জড়িত আছেন, (আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রসিকিউশন, বিচার বিভাগ) তাদের প্রত্যেকে যদি মানবাধিকার নিশ্চিত করে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলেই আমরা সুন্দর, মানবিক ও উন্নত বাংলাদেশ দেখতে পাব।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন, আজ কক্সবাজারে যে রায় হয়েছে এর ভিকটিম ছিলেন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। সুষ্ঠু বিচারের জন্য এ ধরনের রায়ের ক্ষেত্রে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সিনহার সহকর্মীদের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া এবং জনগণের ক্ষোভ।’ তিনি বলেন, ‘২০০৪ থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ এনকাউন্টারের নামে নিহত হয়েছেন। তবে এই প্রথম রায়ের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ দেখলাম। আবারও বলছি, এ ক্ষেত্রে তার পেশার মানুষদের যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। এই বিচারে যে শক্ত বার্তা দেওয়া হয়েছে সেটি খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না, যদি না রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা আন্তরিক হন, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন।’ অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘এ ধরনের রায় সত্যি প্রত্যাশিত ছিল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। এটা প্রমাণ করেছে অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক না কেন সে আইনের বাইরে নয়। তবে সিনহা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় এটি সুষ্ঠু বিচারের ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রেখেছে।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিজ সদস্যদের অপরাধ দমনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেখুন, অনেক ঘটনা দেখা যায় ঘটার পরে সামনে আসে। ওসি প্রদীপের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই সরকারের উচিত হবে পুলিশের বিভাগীয় ও প্রশাসনিক তদন্ত আরও শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে সারা বছরের পুলিশের কার্যক্রম বিচার বিভাগীয় মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া এবং পুলিশ সপ্তাহে তা প্রকাশ করা।’

 

সর্বশেষ খবর