সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

চুড়িহাট্টার আগুনে চার্জশিট শিগগিরই, আসামি ১২

সাখাওয়াত কাওসার

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার সেই ভয়ংকর আগুনের ঘটনার মামলার চার্জশিট দিতে যাচ্ছে পুলিশ। অভিযোগপত্রে ৬৪ চুড়িহাট্টা, নন্দকুমার দত্ত রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই হাসান ও সোহেল ওরফে শরীফসহ অন্তত ১২ জন আসামির নাম থাকছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম বলেন, চার্জশিট প্রস্তুত, শিগগিরই আদালতে দাখিল করা হবে। জানা যায়, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ৬৪ নন্দকুমার দত্ত রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যাল গোডাউনের বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৭১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন। আগুনের ঘটনার দুই দিন পর স্থানীয় বাসিন্দা আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় একই উদ্দেশ্যে অবহেলাপূর্বক অগ্নিসংযোগের কারণে মৃত্যু ঘটানোসহ ক্ষতিসাধনের অপরাধে দন্ডবিধির ৩০৪(ক)/৪৩৬/৪২৭/৩৪ ধারা উল্লেখ করা হয়। মামলার বাদী আসিফের বাবা জুম্মন (৫০) অগ্নিকান্ডে নিহত হন। মামলায় মৃত হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শরীফসহ অজ্ঞাত ১২ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ‘হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে আর্থিকভাবে লাভবান হতে আগুন লেগে মানুষের জানমালের ক্ষতি হবে জেনেও তাদের চারতলা ফ্যামিলি বাড়ির বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ ব্যবসায়ীদের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেন। আসামিদের ৬৪ নম্বর নন্দকুমার দত্ত রোডের বাড়িটির দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় থাকা বডি ¯েপ্র, পলিথিনের দানা ও কেমিক্যালে আগুন লেগে মোট ৭১ জন মানুষের প্রাণহানি হয়।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম বলেন, বিস্ফোরক অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ টিম, ফায়ার সার্ভিস, সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম ও প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। যারা কেমিক্যাল রেখেছিল, কেমিক্যালের মজুদ করেছিল, যারা এই মজুদের বিষয়টি তদারক করেনি- সবাইকে আসামি করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডের উৎসস্থল সেই কেমিক্যাল গোডাউন ‘পার্ল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’-এর মালিক ইমতিয়াজ আহমেদকেও আসামি করা হয়েছে।

আমদানি করা কেমিক্যাল মজুদের জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের অনুমোদিত গোডাউন থাকতে হবে। বৈধ গোডাউনের লাইসেন্স ছাড়াই আমদানি করা হচ্ছে  কেমিক্যাল। আরমানীটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, চানখাঁরপুলসহ আশপাশের এলাকার আবাসিক ভবনে করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ গোডাউন। এসব গোডাউনের অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। মাত্র দুই ভাগ গোডাউনের অনুমোদন আছে। অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বিভিন্ন বাড়ি, মার্কেট ও জনবহুল বিপণিবিতানে গোডাউন স্থাপন করা হচ্ছে। বিস্ফোরক অ্যাক্ট, ১৮৮৪ এবং সিলিন্ডার বিধিমালা, ১৯৯১ তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে এসব অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন। কেমিক্যাল-সংশ্লিষ্ট বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর কিছুদিন সিটি করপোরেশন আরও কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় চালায় অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান। একটা পর্যায়ে কিছুদিন পর অভিযান নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। হাজার হাজার অবৈধ কেমিক্যালের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য করলেও এদের গ্রেফতার তো দূরের কথা, মামলা পর্যন্ত দায়ের হয় না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর প্রায় সবগুলোই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে অবহেলাজনিত কারণে হয়েছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল অনিরাপদ ও অবৈধ গোডাউনে কেমিক্যাল মজুদের কারণে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কেমিক্যাল ব্যবসা করছেন। তারা চরম বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুদ, পরিবহন ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা মানছেন না।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল মোস্তফা বলেন, বিস্ফোরক অধিদফতর কর্তৃক ৩১ ধরনের কেমিক্যালকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ৩১ ধরনের কেমিক্যাল আমদানি ও মজুদের অনুমতি বিস্ফোরক অধিদফতর দিয়ে থাকে। এই ৩১ ধরনের বাইরে আরও বহু ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করা হয়। এসব কেমিক্যাল সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সের বিপরীতে আমদানি ও মজুদ করা হয়। তবে ১০ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের এই ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন স্থগিত রয়েছে। এসব কেমিক্যাল মজুদ করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ নির্মাণ করছে। সেটি চালু না হওয়া পর্যন্ত পুরান ঢাকায় শুধু বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে কেমিক্যাল গোডাউন থাকছে। তবে এসব কেমিক্যালের মধ্যে বিপজ্জনক ৩১টি কেমিক্যাল নেই। বিপজ্জনক ৩১টি কেমিক্যাল শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহার হয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাসায়নিক ব্যবসার জন্য নতুন ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন বন্ধ রেখেছে। সিটি করপোরেশন বলছে, ২০১৯ সালের পর আর কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এমনকি আগের লাইসেন্সও নবায়ন করা হয়নি। কিন্তু ব্যবসা ঠিকই চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈধ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অসংখ্য অবৈধ প্রতিষ্ঠানও পুরান ঢাকায় ব্যবসা করছে। তারা গোপনে বিপজ্জনক ও দাহ্য পদার্থ মজুদ ও বিক্রি করে।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনের বিস্ফোরণে ১২৭ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের আন্দোলনে নামে এলাকাবাসী। ওই ঘটনার পর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। পরে গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান থেমে যায়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে বিস্ফোরণে ৭১ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদে অভিযান চালায়। মাত্র ৩৩ দিন অভিযান পরিচালনা করে ১৭০টি কেমিক্যাল গোডাউন সিলগালা করা হয়। এরপর অদৃশ্য কারণে সেই অভিযান থেমে যায়। এখনো পুরান ঢাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্ত আড়াই হাজার কেমিক্যাল গোডাউনের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। যে কোনো সময়ে নিমতলী ট্র্যাজেডি বা চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির মতো আরও একটি ট্র্যাজেডি ঘটে যেতে পারে।

কেমিক্যাল, গ্যাস ও সিলিন্ডার আমদানিতে এর বিধিমালায় বিস্ফোরক অধিদফতরের অনুমোদিত কেমিক্যাল ও গ্যাস মজুদের গোডাউন থাকা বাধ্যতামূলক। বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স না নিয়ে শুধু সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদামজাত ও খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। অথচ রাসায়নিক মজুদ করতে হলে গোডাউনের নকশা, আমদানির লাইসেন্স, অগ্নিনির্বাপণ সনদসহ কমপক্ষে ১৫টি শর্ত পূরণ করতে হয়। পুরান ঢাকায় বর্তমানে অবৈধভাবে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে ১০ হাজারের মতো। প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচের বেজমেন্টে গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অতি দাহ্য পদার্থ ও কম দাহ্য পদার্থ।

এ ব্যাপারে বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অবৈধভাবে কেউই বিস্ফোরক আমদানি করতে পারে না। চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে পুরান ঢাকায় কোনো কেমিক্যাল গোডাউন দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অবৈধভাবে কেউ গোডাউন স্থাপন করেছেন এমন তথ্য পাওয়া গেলে বিস্ফোরক অধিদফতর অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যারা যেটা করে সেটার নজরদারি তাদেরই থাকা উচিত। কিন্তু বিস্ফোরক অধিদফতরের জনবলের অভাবে আমরা করতে পারি না। এরপরও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোথাও কোনো অবৈধ গোডাউন থাকে সে বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিই।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, ‘বৈধ বা অবৈধ যে পথেই কেমিক্যাল আসুক না কেন, কোথায় মজুদ করা হচ্ছে, কারা আনছে, কীভাবে পরিবহন করা হচ্ছে, কী কাজে ব্যবহার করছে- সেটা সরকারকে জানানো জরুরি। যেহেতু আমরা কেমিক্যাল তৈরি করি না তাই এর আমদানি বন্ধ করা যাবে না। তবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কেমিক্যাল খালাসের পর এর পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট শিল্প মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কেমিক্যালগুলো অনেকটা অনিরাপদ অবস্থায় পরিবহন করা হয়। পরিবহনের একটি নীতিমালা থাকা উচিত। কেমিক্যালগুলো কীভাবে মজুদ করা হচ্ছে সে বিষয়েও নজরদারি থাকা জরুরি।’

সর্বশেষ খবর