শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
খেলাধুলার মাধ্যমে দুই বাংলার মিলনের ডাক

সায়েম সোবহান আনভীরকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সংবর্ধনা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

সায়েম সোবহান আনভীরকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সংবর্ধনা

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের চেয়ারম্যান সায়েম সোবহান আনভীরকে আজীবন সদস্য পদ ও সংবর্ধনা দেয় কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বাংলাদেশের শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ফুটবল ক্লাবের কর্ণধার ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে গতকাল সংবর্ধনা দিয়েছে। অনুষ্ঠানে তাঁকে আজীবন সদস্য পদও দেয় কলকাতা তথা ভারতের ঐতিহ্যমন্ডিত এ ফুটবল ক্লাব। ক্লাব প্রাঙ্গণে আয়োজিত জমকালো এ অনুষ্ঠানে সায়েম সোবহানের হাতে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি ও মেম্বারশিপ কিট তুলে দেন ইস্টবেঙ্গলের সচিব কল্যাণ মজুমদার। গোল্ড কয়েন তুলে দেন ক্লাবের সহসচিব রূপক সাহা, দেবব্রত সরকার। পরে সবাই মিলে গ্রুপ ফটো তোলা হয়। লাল-হলুদ বেলুনও আকাশে ওড়ান সস্ত্রীক সায়েম সোবহান।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সায়েম সোবহানের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সহসভাপতি শান্তি রঞ্জন দাশগুপ্ত, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি সুব্রত দত্ত, আইএফএ সভাপতি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহসভাপতি ইমরুল হাসান ও বসুন্ধরা মিডিয়া গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আরও ছিলেন- সমরেশ চৌধুরী, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, অলোক মুখোপাধ্যায়, অতনু ভট্টাচার্য, মেহদাব হোসেন, রহিব নবী, আলভিটো ডিকুনহাসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ফুটবলার।

সায়েম সোবহান তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনাদের আন্তরিকতা আমায় শুধু মুগ্ধই করেনি, এ ক্লাবের আজীবন সদস্য করে আপনারা আমায় কিনে ফেলেছেন। এত সুন্দর সুসংগঠিতভাবে  আমাকে স্বাগত জানানো হলো, আমি সত্যিই অভিভূত। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সব সময় নিজের ক্লাব বলেই ভেবেছি। তাই তারা যখন আমন্ত্রণ জানালেন, তখন আর “না” বলিনি। আমরা চাই দুই বাংলার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ও সাধারণ মানুষ আরও কাছাকাছি আসুক।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে যেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আমিও আপনাদের (ইস্টবেঙ্গল) গোটা টিমকে বাংলাদেশে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানাব।’ সায়েম সোবহান বলেন, ‘দুই বাংলার সংস্কৃতি এক, ভাষা এক। মাঝখানে শুধু একটা লাইন মানে সীমান্তরেখা এসে পড়েছে। তার অর্থ এই নয় যে খেলা আমাদের বন্ধ থাকবে। দুই বাংলার সম্পর্ক নিবিড় করার জন্য আমাদের খেলা উচিত।’ শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ ক্রীড়া চক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের নামে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আমাকে এ ক্লাবটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ কাজে তাঁর কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতাও আমরা পাচ্ছি।’

সায়েম সোবহান জানান, খুব শিগগিরই শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হবে যার পুরোটাই তিনি স্পন্সর করবেন।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষ থেকে দেবব্রত সরকার বলেন, ‘ভারতীয় ফুটবল ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সময়সূচি মিলে গেলে দুই ক্লাবের মধ্যে ওই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশে গিয়ে খেলব।’

এর আগে এদিনের অনুষ্ঠানে সায়েম সোবহান আনভীরকে উত্তরীয় পরিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তরফ থেকে সম্মান জানানো হয়। পুষ্পস্তবক দেন শান্তি রঞ্জন দাশগুপ্ত। ফলের বাস্কেট তুলে দেন সৈকত গাঙ্গুলি। নানা স্বাদের মিষ্টি ও দই তুলে দেন সঞ্জীব আচার্য। পায়জামা-পাঞ্জাবি তুলে দেন রজত গুহ।

সাবরিনা সোবহানকেও অনুরূপ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উত্তরীয়, মিষ্টি দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয় বাফুফে সহসভাপতি ইমরুল হাসানকেও। ইমরুল হাসান বলেন, ‘সায়েম সোবহান শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যানই শুধু নন, তিনি বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের প্রধান উপদেষ্টা। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি যেভাবে ফুটবলের জন্য সময় দেন, ভালোবাসেন তাঁর সান্নিধ্যে না থাকলে ওটা বুঝতাম না। উনি বাংলাদেশে ফুটবলের জাগরণ তৈরি করেছেন, আমরা চাই সে জাগরণ এপার বাংলায়ও যেন ছড়িয়ে পড়ে। বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিটি সদস্যই ক্রীড়াপ্রেমী, বিশেষ করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান নিজেও খেলা-অন্তপ্রাণ মানুষ। তাই এ পরিবার যখন খেলাধুলায় হাত দেয়, তা হীরায় পরিণত হয়।’

সচিব কল্যাণ মজুমদার বলেন, ‘আমি গর্বিত বোধ করছি, চাকরিসূত্রে বাংলাদেশেও ছিলাম, বাংলাদেশেও অনেক প্রিয় মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু বসুন্ধরার সঙ্গে আমার স্মৃতি অমোঘভাবে আছে এবং তা আবার প্রজ্বলিত হলো সায়েম সোবহানকে সস্ত্রীক দেখে। আমরা চাই বারে বারে সায়েম সোবহান সাহেবের পদার্পণ এখানে ঘটুক।’

সুব্রত দত্ত বলেন, ‘বাংলাদেশে যতবার যাই মনে হয় আমি আমার বাড়িতেই আছি, আমার দেশেই আছি। গঙ্গা ও পদ্মা দুই নদী কিন্তু তার একটা হৃদয়, অন্যটা ফুসফুস। মনের দিকে কোনো সীমারেখা নেই, ভৌগোলিক সীমারেখা আছে কিন্তু মনেপ্রাণে বাঙালি। আমাদের সবকিছুতেই ফুটবল। আমরা চাই এ খেলা কেন্দ্র করেই দুই দেশের মৈত্রী, সুসম্পর্ক আরও শক্তিশালী হোক।’ সুব্রত দত্ত করোনাকালে বসুন্ধরা গ্রুপের জনসেবা কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, যারা ফুটবলের সেবা করেন তারা সমাজসেবক। তাই আনভীর ও তাঁর টিম সদস্যরাও সমাজসেবক, তাঁরা যুবসমাজকে সঠিক পথ দেখান, বিপথে যেতে দেন না।

ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাস : ভারতের ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২০ সালের ১ আগস্ট তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) আবেগের স্ফুলিঙ্গ থেকে জন্ম নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, শৈলেস বসু ও নসা সেন- এ তিন পূর্বপুরুষের হাত ধরে শুরু হয়েছিল খেলার মাঠে পূর্ববঙ্গের অস্তিত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। দল প্রথম মাঠে নামে ১১ আগস্ট হারকিউলিস কাপে। তখন পূর্ববঙ্গের বহু বিত্তবান মানুষ ছিলেন শহর কলকাতায়। আবেগী স্রোতে ভেসে যেতে এগিয়ে আসেন তারাও।

তার ঠিক এক বছর পর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব মোহনবাগানের সঙ্গে ভাগাভাগি করে চলে আসে ময়দানে। যা বর্তমান ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরপর ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদন পাওয়া এবং কলকাতা ফুটবল লিগের প্রস্তুতি। জন্ম নেয় ঘটি-বাঙালের লড়াই। ১৯২৫ সালে ইস্টবেঙ্গল সুযোগ পায় প্রথম ডিভিশনে খেলার। সুযোগ পেয়েই হারায় মোহনবাগান দলকে।

মাঠের বাইরে বাঙালদের হেয় করার জবাব প্রথমবার ফুটবলের মাধ্যমে দেয় ইস্টবেঙ্গল। ঘটিদের কৌলিন্যে সেটাই ছিল প্রথম এক সজোরে আঘাত। এরপর মাঠের বাইরে ফুটবল রাজনীতিতে জর্জরিত হয়ে ইস্টবেঙ্গলকে নেমে যেত হয় প্রথম ডিভিশন থেকে। সভ্য-সমর্থকরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে। সে প্রতিবাদের মশালই পরে হয়ে ওঠে ক্লাবের প্রতীক।

১৯৩১ সালে আবার ক্লাব উঠে আসে প্রথম ডিভিশনে। এরপর ভারতের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে প্রভাব বিস্তার করে ইস্টবেঙ্গল। চীনের অলিম্পিক দলকে হারানোর পর ইউরোপ সফর শুরু করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। পরপর জেতা এবং ড্র, খালি পায়ে ইস্টবেঙ্গলের লড়াই দেখে গোটা ইউরোপ বিস্মিত হয়ে যায়।

এরপর ’৭০-এর দশকে শুরু হয় ইস্টবেঙ্গলের সোনালি যুগ। খানসেনাদের অত্যাচারে যখন বাংলাদেশের মানুষ শরণার্থী হয়ে আসতে শুরু করে কলকাতায় তখন হাজারো কষ্টে, ব্যথা-বেদনায় সে সময় তাদের একমাত্র বিনোদন ছিল এই ইস্টবেঙ্গলের খেলা। সভ্য-সমর্থকদের দেশ ছাড়ার ক্ষোভ প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। দর্পে-গর্বে-প্রতিবাদে, ইতিহাসের পাতায় ক্লাবটি পাকাপাকি জায়গা করে নেয়। শতাব্দীপ্রাচীন সেই ক্লাবের বিরামহীন আজও পথচলা।

প্রতিবাদের আগুন থেকে তৈরি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর খেলাতে ফুটবল, সেই খেলাতে সেরা দল আমার-তোমার-সবার ইস্টবেঙ্গল।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর