রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

হাবিবুলের নেতৃত্বে নতুন কমিশন

সাবেক তিন সচিব, এক বিচারক ও একজন সেনা কর্মকর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাবিবুলের নেতৃত্বে নতুন কমিশন

সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে আইন করে সে অনুযায়ী প্রথমবারের মতো গঠন হলো দেশের ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল।

আর চার নির্বাচন কমিশনার হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান।

গতকাল সাপ্তাহিক  ছুটির দিনে এ বিষয়ে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি তাদের নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিয়েছেন।

নবগঠিত ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তিনজনই সাবেক সিনিয়র সচিব। একজন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আজ রবিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের শপথ হবে।

প্রজ্ঞাপন জারির পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘যদি সবাইকে নিয়ে একটি সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারি তবে হয়তো সফলতার সুখ কিছুটা ভোগ করতে পারব, নতুবা মনোবেদনা থাকবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’ পাশাপাশি নিয়োগ পাওয়া অন্য কমিশনাররাও দেশ-জাতির কল্যাণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিইসি নিয়োগ পাওয়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের জন্ম ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তার বাবা কাজী আবদুল আউয়াল ডিআইজি (প্রিজন) ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা মামলার বাদী ছিলেন।

হাবিবুল আউয়াল ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও ১৯৭৮ সালে এলএলএম ডিগ্রি অর্জনের পর আইনজীবী হিসেবে ১৯৮০ সালে বার কাউন্সিলের সনদ পান। ১৯৮১ সালে তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী জজ পদে নিয়োগ পান। ১৯৯৭ সালে তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। বাংলাদেশ ল কমিশনের সেক্রেটারি, শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রেষণে সহকারী সচিব ও উপসচিব হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব নিযুক্ত হয়ে ২০০৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হন। ২০০৭ সালের ২৮ জুন তিনি একই মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে উন্নীত হন। ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল তাকে রাষ্ট্রপতির ১০ শতাংশ কোটায় প্রথমে ধর্ম সচিব এবং পরে প্রতিরক্ষা সচিব পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল হাবিবুল আউয়ালের। কিন্তু ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি পিআরএল বাতিল করে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার। পরে সেই চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। ২০১৭ সালে অবসরে যান তিনি। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মো. আলমগীর বিসিএস ১৯৮৪ (পঞ্চম) ব্যাচের কর্মকর্তা। সর্বশেষ তিনি নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব হিসেবে গত বছরের জানুয়ারিতে পিআরএল এ যান। এর আগে ২০১৯ সালের ১০ জুন নির্বাচন কমিশনের সচিব পদে নিয়োগ পান। সেখানে যোগদানের তিন মাসের মাথায় তিনি সিনিয়র সচিব হন। দেড় বছর নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে কাজ করেন মো. আলমগীর। এর আগে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ছিলেন। তারও আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবের হজ মিশনের কাউন্সিলর পদেও দায়িত্ব পালন করেন। অপর কমিশনার আনিছুর রহমান বিসিএস ১৯৮৫ (সপ্তম) ব্যাচের কর্মকর্তা। সর্বশেষ তিনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ছিলেন। এর আগে তিনি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। তারও আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। অপর নির্বাচন কমিশনার ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এলএলএম ডিগ্রি নেন। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ করে সরকার। আইন অনুসারে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্য ছিলেন-সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনারদের প্রতিক্রিয়া : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘নির্বাচনের প্রতি একদল মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ এইসব ভোটারের নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফেরানো। আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় আমরা সেই ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া ভোটে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে সেটিও আমাদের মাথায় আছে। ভোটকেন্দ্রে যেন কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে সে বিষয়ের প্রতিও আমাদের মনোযোগ আছে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে কীভাবে আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর করা যায় এবং সব দলকে কীভাবে নির্বাচনে নিয়ে আসা যায় সে ব্যাপারেও এই নির্বাচন কমিশন কাজ করবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর একটি দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। এই দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করব।’ সিইসি বলেন, ‘কমিশনের অপর সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাদের নিয়ে বসে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করব।’ নিয়োগ পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সন্ধ্যায় তিনি গণমাধ্যমকে এসব কথা বলেন।

নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চাইব। নির্বাচন বিষয়টি আপেক্ষিক। সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। আর সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।’ তিনি বলেন, ‘সিইসি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আমি আমার সব সহকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করব। কিতাবে কী লিখা আছে তা দেখব। জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র দুই বছরের মতো সময় বাকি আছে। তাই প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি সবাইকে নিয়ে একটি সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারি তবে হয়তো সফলতার সুখ কিছুটা ভোগ করতে পারব, নতুবা মনোবেদনা থাকবে।’

একইভাবে দেশবাসীর কল্যাণে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচন কমিশনার হওয়াটা অবশ্যই আমার কাছে আনন্দের বিষয়। সবার ভাগ্যে তো এটা হয় না। দেশবাসীর জন্য যা কল্যাণকর-মঙ্গলজনক হবে, আমার চেষ্টা থাকবে সেই কাজ করার।

নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, সবার কাছে যেন আমাদের কাজ গ্রহণযোগ্য হয়, সেই হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করব। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, যেন সুস্থভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। ইসির সাবেক এই সচিব বলেন, আমরা চেষ্টা করব, অতীতের শিক্ষা, অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করার। ইসির সিনিয়র সচিব হিসেবে কাজ করেছি। যদি কোনো ত্রুটি আছে বলে মনে করি বা যেগুলো মানুষের মনে আছে, চেষ্টা করব যেন ত্রুটিগুলো না থাকে। অবশ্যই আমরা সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করব।

আইন ও সংবিধান অনুযায়ী যে ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। গতকাল গণমাধ্যমের কাছে এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন তো একক নয়, সবাই মিলেই। আলোচনা করেই ঠিক করা হবে পরবর্তী করণীয়। আমাদের সামনে কী আছে, কোন বিষয়গুলো আমরা অগ্রাধিকার দেব সেগুলো আমরা বিবেচনা করব।

সর্বশেষ খবর