বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

সংলাপের পর নির্বাচনী রোডম্যাপ

গোলাম রাব্বানী

সংলাপের পর নির্বাচনী রোডম্যাপ

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করে পরামর্শের আলোকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য  দেড় বছর হাতে রেখে আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করার চিন্তা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের জন্য নতুন নির্বাচন কমিশনের কী করণীয় এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়, সেই পথ নির্দেশনাও চাওয়া হবে সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্টজনদের কাছে।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, আগামী রবিবার ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হবে সংলাপের। ২২ মার্চ সংলাপ হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সুশীল সমাজের সঙ্গে। মার্চের শেষ দিকেও এক দফা সংলাপের তারিখ রাখার চিন্তা চলছে। এক্ষেত্রে তিন-চার মাসের মধ্যে সংলাপ শেষ করার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। আর স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করবে। যদিও সদ্য বিদায়ী নূরুল হুদা কমিশন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে ১৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের (কর্মপরিকল্পনা) রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল। এর পর ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সংলাপের যাত্রা শুরু করেছিল। তবে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন এবার সংলাপের পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ করার কথা বলছে। ইসি জানিয়েছে, তারা পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা, নারী নেত্রী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, আমরা এখনো কোনো নিজস্ব কর্মপন্থা বা কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঠিক করিনি। অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ তথা আলাপ-আলোচনা করার পরই কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব। সংলাপ শেষে আমরা কর্মপরিকল্পনার একটি খসড়া করব। এরপর তা নিয়ে আবার আলাপ-আলোচনা হবে। তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা বিশ্লেষণ করব। এর পরই চূড়ান্ত করা হবে সেই কর্মপরিকল্পনা। আমাদের মেয়াদকালে যেসব কাজ করা সম্ভব আমরা কর্মপরিকল্পনায় সেগুলোই বেছে নেব। তিনি বলেন, যেগুলো আইনকানুন সাপোর্ট করে আমরা সেগুলো করব। এরপর দেখব যদি কোনো আইন-কানুন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তবে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা পরিবর্তনের প্রস্তাব দেব। তারা যদি অনুমোদন দেন তখন আমরা তা বাস্তবায়ন করব। আর যে কাজগুলো নির্বাচন কমিশনের হাতে সেগুলো অল্প সময়ের মধ্যে আমরা করতে পারব, সেগুলো করা যাবে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল হচ্ছে প্রধান স্টেকহোল্ডার। অবশ্যই তাদের সঙ্গে আমরা সংলাপে বসব। এক্ষেত্রে আমরা শুধু ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করব।

সংলাপের এজেন্ডার বিষয়ে তিনি বলেন, সংলাপে কোনো এজেন্ডা থাকবে না। সংলাপে উন্মুক্ত আলোচনা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত; নির্বাচন কমিশনের কী ভূমিকা থাকবে, স্টেকহোল্ডাররা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সেই বিষয়গুলো আলোচনা হবে। আমরা শুধু পরামর্শ নেব না; স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা নিয়েই কাজ করব।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। এক্ষেত্রে চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসির হাতে প্রায় দেড় বছর সময় থাকবে। বিগত নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১০০ আসনে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি রেখে গেলেও নতুন ইসি ইভিএম’এ ভোট গ্রহণের বিষয়ে সংলাপে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নেবে।

বিশ্লেষকদের মতে, গত দুটি কমিশন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।  জনগণ ভোট কেন্দ্রমুখী হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। তারা বলছেন, আস্থার সংকট নিরসন করা নতুন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই সংলাপ আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জানা গেছে, দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রথাগতভাবে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি। ২০০৮ সালে ইসির নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়, পরে ড. এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের মেয়াদকালে দুবার সংলাপে বসেছিলেন বিভিন্ন মহলের সঙ্গে। এ ছাড়া কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশনের সময়ও সংলাপ হয়েছিল। এ ছাড়া সদ্য বিদায়ী নূরুল হুদা কমিশনের সংলাপে ৩৯টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন। সংলাপে ৫০টি সুপারিশ পেয়েছিল তারা। সংলাপে আসা সুপারিশগুলো তিন ভাগে ভাগ করেছিল ইসি। এর মধ্যে একটি ছিল সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রস্তাব ও সুপারিশ, দ্বিতীয়- রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ, তৃতীয়ত- নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ। তবে নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাসহ ৩৪টি প্রস্তাব ও সুপারিশকে নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছিল নূরুল হুদা কমিশন। তবে বেশিরভাগ সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি।

কী থাকতে পারে রোডম্যাপে : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রকাশ করার চিন্তা করছে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই রোডম্যাপে সাত থেকে আটটি করণীয় বিষয় নির্ধারণ করা হতে পারে। তবে তা সংলাপে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে। রোডম্যাপে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কারের বিষয় থাকবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করা; ইভিএম’এ ভোট গ্রহণ; সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ; ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ; বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোট কেন্দ্র স্থাপন; নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কার্যক্রম গ্রহণের নির্ধারিত টাইমফ্রেম থাকবে।

সর্বশেষ খবর