সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

কার্গোর ধাক্কায় ফের লঞ্চডুবি

শিশুসহ ছয় লাশ উদ্ধার নিখোঁজ অন্তত ২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

কার্গোর ধাক্কায় ফের লঞ্চডুবি

কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চ ডোবার দৃশ্য (বাঁয়ে)। স্বজনদের কান্না -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে জাহাজের ধাক্কায় মর্মান্তিক লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে এমএল আফসার উদ্দীন নামের ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের ইসলামপুর এলাকার মৃত জুলফিকার আলীর ছেলে জয়নাল ভূইয়া (৫৪), আরিফা আক্তার (৩৫) ও তার ১৫ মাসের শিশু শাফায়েতের পরিচয় জানা গেছে। তবে এখনো পর্যন্ত অন্তত ২০-২৫ জন যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিআইডব্লিউটিএ) ড. আ ন ম বজলুর রশিদকে প্রধান করে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত  কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বিকাল ৫টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁ মেঘনা ঘাট এলাকা থেকে ‘এমভি রূপসী-৯’ এর চালকসহ জাহাজটি আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম। জানা গেছে, বেলা ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল ঘাট থেকে আফসার উদ্দীন নামের লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বেলা ২টা ১০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের চর সৈয়দপুরের আলামিন নগর ব্রিজের অদূরে ‘এমভি রূপসী-৯’ নামের কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি মুহূর্তেই তলিয়ে যায়। ডুবে যাওয়ার হৃদয়বিদারক এ দৃশ্যটি দেখেন নদীতে থাকা বিভিন্ন নৌযান এবং দুই পাড়ের মানুষ। তাদের চোখের সামনে লঞ্চটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় তলিয়ে যেতে দেখলেও তারা ছিলেন অসহায়। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। গত রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে আপাতত অভিযান স্থগিত করে ফায়ার সার্ভিস এবং নৌ পুলিশ। তবে একাধিক টিম ঘটনাস্থলে অবস্থান করবে। ভোরে উদ্ধার অভিযান আবার শুরু হবে। এ ছাড়া মর্মান্তিক লঞ্চডুবির দৃশ্যটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অল্প সময়ের মধ্যেই তা রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। কমেন্টে অনেকেই জীবনের অনিরাপত্তাসহ নানা মন্তব্য করেছেন।  আলামিন নগর এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা মো. কবির মিয়া জানান, তিনি নদীতে পশ্চিম পাড়ে গোসল করছিলেন। মুন্সীগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল এমভি আফসার উদ্দীন নামের লঞ্চটি। একইভাবে কার্গো জাহাজটিও লঞ্চের পেছন দিয়ে যাচ্ছিল। তবে লঞ্চটি হঠাৎ করেই জাহাজের ঠিক সামনের দিকে আটকে যায়। এ সময় কার্গো জাহাজটি লঞ্চটিকে টেনে প্রায় ১০-১৫ হাত দূরে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে লঞ্চটি পশ্চিম দিকে হেলে গিয়ে মুহূর্তেই তলিয়ে যায়। ১৫ থেকে ২০ জন যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু লঞ্চের নিচ তলায় ও উপরের তলায় কেবিনে থাকা কেউ বের হতে পারেননি। এ সময় নদীর পাড়ে নোঙর করে থাকা বেশ কয়েকটি জাহাজ থেকে নদীতে সাঁতরাতে থাকা যাত্রীদের রক্ষায় বায়া ফেলা হয় (ভেসে থাকার জন্য চাকাবিশিষ্ট)।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নদীর পাড়ের বাসিন্দা গৃহিণী সালমাসহ বেশ কয়েকজন জানান, লঞ্চ ডোবার পরই নদীতে একজন নারী দুই হাতে দুজন শিশুকে নিয়ে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতে করতে তলিয়ে গেছেন। এ দৃশ্য দেখেই অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী অপর একজন ওমর ফারুক বলেন, ৫৫ বছরের নিহত জয়নাল হার্টের রোগী ছিলেন। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর সাঁতরে তীরে উঠেছিলেন জয়নাল ভূঁইয়া। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান।

নদীর পাড়ে থাকা আহাজারি করতে থাকা মুন্সীগঞ্জের আয়নাল জানান, তার ভাই দেলোয়ার নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন। তিনি এখন নদীতে নিখোঁজ রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান রাত পৌনে ৯টায় নদীর পাড়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত করে তা বেঁধে রাখা হয়েছে। যাতে স্রোতে অন্যত্র চলে না যায়। লঞ্চটি উদ্ধারে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ আজ (রবিবার রাতেই) ঘটনাস্থলে পৌঁছবে। আমাদের ধারণা আরও ১০-১৫ জন নিখোঁজ থাকতে পারে। উদ্ধারকারী জাহাজ লঞ্চটি নদীর তল থেকে তুলে আনলে বোঝা যাবে। এখানে নদীর গভীরতা ৩০-৩৫ মিটার। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার জন্য নদীর পাড়ে বিভিন্ন জাহাজ নোঙর করে রাখা দুর্ঘটনার একটি কারণ হতে পারে। বিশেষ করে ওই সব জাহাজ নদীর পাড়ে নোঙর করে রাখায় নদীর পথ সরু হয়ে গেছে।  নদীর পাড়ে উদ্ধার অভিযানে পরিদর্শনে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম জানান, নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প-কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার জাহাজ নদীর পাড়ে যেখানে সেখানে নোঙর করে রাখা হয়। এতে নদীর প্রশস্ততা সরু হয়ে থাকে। এসব কারণে নদীতে চলমান যান সঠিকভাবে চলতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে নদীর মধ্যে উদ্ধার অভিযানে ডুবুুরি দলের সঙ্গে থাকা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা ইউএনও রিফাত বিন ফেরদৌস জানান, সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিট পর্যন্ত তিনজন নারী, দুজন শিশু ও একজন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার অভিযান চলবে গভীর রাত পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ মুঠোফোনে জানান, এ ঘটনায় জেলা এডিএম শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যাদের লাশ পাওয়া গেছে এবং পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তাদের প্রত্যেক লাশের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে।

ঘাতক জাহাজ চালকসহ আটক : মর্মান্তিক লঞ্চডুবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ‘এমভি রূপসী-৯’ এর চালকসহ সব স্টাফ ও কর্মীদের আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌ পুলিশপ্রধান শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঘটনার পর পরই কার্গো জাহাজের সংশ্লিষ্টদের আটক করতে অভিযানে নেমে পড়ি। একই সঙ্গে ডুবে যাওয়া যাত্রীদের উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত রাখি। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর