বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

নজিরবিহীন অরাজকতা বিমান ভাড়ায়

ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভাড়া বৃদ্ধি, দিশাহারা প্রবাসীরা

মির্জা মেহেদী তমাল

ঢাকা-রিয়াদ রুটে ৪০ হাজার টাকার বিমান ভাড়া এখন ৯২ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ৪৫ হাজার টাকার ঢাকা-দুবাইয়ের রিটার্ন ভাড়া এখন ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। ভারতের সব রুটে ভাড়া বেড়েছে ৩ থেকে ৪ গুণ। কোনো কোনো দিন এ ভাড়া ৮/১০ গুণও গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। আকাশপথের ভাড়া নিয়ে চলছে এমনই নজিরবিহীন অরাজকতা। কোনো কারণ ছাড়াই ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভাড়া বৃদ্ধিতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুচ্ছ অজুহাতে আকাশপথের সব রুটে ভাড়া বাড়িয়েছে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো। কি শ্রমিক কি ব্যবসায়ী- সবাইকে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এভাবে বাহরাইন, কুয়েত, কাতার ও আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তুঘলকি কায়দায়। সিট নেই, যাত্রীর চাপ বেশি এসব কারণ দেখিয়ে লাখ লাখ গরিব শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অভিবাসী ব্যয় বেড়েছে, তেমনি অস্থিরতা ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে দেশের এভিয়েশন সেক্টরে।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, ভাড়ায় হস্তক্ষেপ করা বা লাগাম টানার দায়িত্ব সরকারের নয়। এটি এই খাতের ব্যবসায়ীরাই ঠিক করবেন। তাদের করার কিছুই নেই। সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি বাংলাদেশ (আটাব), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা), হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এবং সাধারণ যাত্রীরা আলাদাভাবে এই ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আটাব এবং বায়রা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু গলাকাটা ভাড়ার কথা অস্বীকার করছে এয়ারলাইনসগুলোর কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে ভাড়ার বিষয়টি ফয়সালা করা উচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালের চেয়ে প্রায় দুই থেকে তিন গুণ ভাড়া বেশি নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো। কলকাতা থেকে দুবাই যেতে একজন যাত্রীকে ওয়ানওয়ে বিমান ভাড়া দিতে হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেখানে ঢাকা থেকে বিমান ভাড়া বাবদ বাংলাদেশিদের গুনতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। আবার নেপাল থেকে দুবাই যেতে যাত্রীদের দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ থেকে এই ভাড়া তিন গুণ। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই বাংলাদেশিদের গুনতে হচ্ছে এমন পকেটকাটা ভাড়া। বাংলাদেশ বিমান, এমিরেটস, কাতার, টার্কিশ, ফ্লাই দুবাইসহ অন্যান্য শীর্ষ এয়ারলাইনসের ভাড়া একইভাবে আকাশচুম্বী বাড়ানো হয়েছে। এই অস্বাভাবিক ভাড়ায় দিশাহারা প্রবাসীকর্মীরা। তারা বছরে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠান তার একটি বড় অংশ লুটে নিয়ে যাচ্ছে এয়ারলাইনসগুলো। লুটপাট বন্ধ করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার পরও কোনো সুরাহা হয়নি। আবার বেবিচকও এ বিষয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। তারা এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার পরও এয়ারলাইনসগুলো তা আমলে নিচ্ছে না। বলা যায় বেবিচকের নির্দেশ অমান্য করেই ভাড়া বৃদ্ধির নামে যাত্রীদের পকেট কাটছে সব এয়ারলাইনসই। বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে কেন এমন অস্বাভাবিক ভাড়া নিচ্ছে এয়ারলাইনসগুলো তার কোনো স্বচ্ছ জবাব নেই কারও কাছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আকাশ পথে ভাড়া নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই।

ভাড়া বৃদ্ধির নামে এ ধরনের নৈরাজ্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে দেশের এয়ারলাইনসগুলোর অ্যাসোসিয়েশন ‘বোর্ড অব এয়ারলাইনস রিপ্রেজেন্টেটিভ’ (বার)-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও দেশের শীর্ষ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই কারসাজি করা হচ্ছে বেশি। কেননা করোনা কমে আসায় এখন হঠাৎ শ্রমিকদের ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া আটকে পড়া শ্রমিকরাও কাজে ফেরার জন্য উদগ্রীব। সে সুযোগটাকেই পুঁজি করছে বিমানসহ কয়েকটি এয়ারলাইনস। তিনি বলেন, মূলত এদেশের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইনসই যখন এসব রুটে ভাড়া বাড়িয়েছে অস্বাভাবিক হারে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো সেটাকেই ফলো করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিমানকেই আগে ভাড়া কমাতে হবে। ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব কার, জানতে চাইলে আশীষ রায় চৌধুরি বলেন, এয়ারলাইনস ব্যবসা দুনিয়াব্যাপী কিছু গাইডলাইনে চলে। ভাড়া যদি অস্বাভাবিক কিংবা অযৌক্তিক হয় সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব রেগুলেটর হিসেবে সিভিল এভিয়েশনের। তারা এয়ারলাইনসগুলোকে ডেকে এর ব্যাখ্যা চাইতে পারে। এ ছাড়া সব এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে বিষয়টির সুরাহা করতে পারে। সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, কমার্শিয়াল ইস্যুতে বেবিচকের হস্তক্ষেপ করার তেমন সুযোগ নেই। তারপরও আমরা এয়ারলাইনসগুলোকে ডেকে ভাড়া কমানোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ ভারত নেপাল পাকিস্তান আশপাশের কোনো দেশের ভাড়া বাড়েনি। শুধু ঢাকায় কেন এত ভাড়া বাড়বে। এমন যুক্তি দেখিয়ে কৈফিয়ত চাওয়ার পরও তারা তেমন কোনো সায় দেয়নি। উল্টো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের চার্জ বাড়িয়েছে, তাই নাকি ভাড়া কিছুটা বেড়েছে। আটাব-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক শাহাদাত হোসেন তসলিম বলেন, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ ধরনের অস্বাভাবিক ভাড়া আদায় করছে বিমানসহ বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো। টিকিটের দাম বৃদ্ধি ও বুকিং পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দরকার। এয়ারলাইনসগুলোকে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় ভাড়া নির্ধারণ করে যাত্রীদের স্বার্থটাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এদিকে টিকিটের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি কোনো কোনো দেশের টিকিট হাওয়া হয়ে গেছে। আগামী জুলাই পর্যন্ত চীনের কোনো রুটে টিকিট নেই। খোদ চীনের নাগরিকরা তাদের দেশে ফিরতে পারছেন না টিকিট না থাকায়। বাংলাদেশ থেকে দুটি এয়ারলাইনস চীনের কয়েকটি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করলেও আগামী জুলাই পর্যন্ত তাদের হাতে কোনো টিকিট নেই। চীনগামী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভ্রমণ তো বন্ধই রয়েছে। এই অবস্থায় চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে এরকম হাজার হাজার বাংলাদেশিকে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। ভুক্তভোগীরা মনে করছেন, প্রতি বছর এ সময়ে একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বিমানের ভাড়া বাড়ায়। এভাবে হাতিয়ে নেয় শত শত কোটি টাকা।

সর্বশেষ খবর