রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বছর ঘুরে আবার এলো রমজান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বছর ঘুরে আবার এলো রমজান

আহলান সাহলান মাহে রমজান! সুস্বাগতম হে রমজান! করোনা আতঙ্কমুক্ত পৃথিবীতে মোবারকবাদ হে রমজান! রমজান এলেই সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতটির প্রচার-প্রসার বেড়ে যায়। ইলমি মজলিস তো বটেই এমনকি জনসাধারণের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিল, দোয়া মাহফিলেও এ আয়াতটি বারবার শোনা যায়। ‘হে ইমানদারগণ!

তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। আশা করা যায় তোমাদের ভিতর তাকওয়ার গুণ অর্জন হবে।’ আয়াতে ‘কুতিবা আলাইকুম’ শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে সিয়াম পালন একটি আবশ্যিক ইবাদত। রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নর-নারীর ওপর অবশ্য কর্তব্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত করে পানাহার ও কামাচার বর্জন করা। ধর্মসম্মত কারণ ছাড়া সিয়াম পালন থেকে বিরত থাকা মুসলিম পরিচয়ের পরিপন্থী। মহানবী (সা.) মাহে রমজানের সিয়াম পালনকে ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ বলে উল্লেখ করেছেন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ইসলাম পাঁচটি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত- এ মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল, সালাত আদায় করা, জাকাত দেওয়া, হজ করা ও রমজানের সিয়াম পালন করা। সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতের সরল তরজমার দিকে তাকালে তিনটি কথা সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে। প্রথমত, বিশ্বাসী বান্দাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ। দ্বিতীয়ত, অতীতের বিশ্বাসীদের ওপরও সিয়াম সাধনা ফরজ ছিল। তৃতীয়ত, এর ফলে বিশ্বাসী বান্দা মুত্তাকি বান্দা হওয়ার গুণাবলি অর্জন করে। সিয়াম সাধনার মোদ্দা কথাই হলো তাকওয়া তথা আল্লাহসচেতন হওয়া। আরবি ‘সিয়াম’ অর্থ ত্যাগ করা, বাদ দেওয়া, বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। কিন্তু শুধু পানাহার আর যৌনাচার থেকে বিরত থাকলেই মানুষ মুত্তাকি হয়ে যায় না। কেননা, বহু মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে, স্ত্রী পরিবার থেকে দূরে থাকে, তার মানে কি সে সিয়াম সাধক মুত্তাকি বান্দা! মোটেও না। বরং সিয়াম সাধনা আরও বড় বিষয়। হাকিকতে সিয়াম হলো- সব ধরনের তাগুতকে রিজেক্ট করে দেওয়া, বাদ দেওয়া। সংক্ষেপে তাগুতের পরিচয় বলা যায়- ‘যে বা যা আল্লাহ থেকে বান্দাকে দূরে সরিয়ে দেয়।’ তাগুতি শক্তি মানুষের ভিতরেও থাকতে পারে, আবার বাইরেও থাকতে পারে। তবে ভিতরের তাগুতই সবচেয়ে বড়। সে তাগুতের নাম নফস। মানুষ সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হলেও নফসের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়া বেশ দুঃসাধ্য। তবে একবার কারও নফস পরাজিত হলে সে মুত্তাকি বান্দায় পরিণত হয়। মুত্তাকি বান্দা আরও উচ্চতর সাধনার মাধ্যমে নফসে মুতমাইন্না তথা প্রশান্তচিত্তের অধিকারী হয়ে ওঠে।

সারাদিন না খেয়ে এবং যৌনাচার না করার ফলে মানুষের দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহের সঙ্গে সম্পর্ক নফসের। দেহ দুর্বল হলে নফসও দুর্বল হয়ে যায়। নফস দুর্বল হলে রুহানি শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার পথ খুলে যায়। তখন বেশি বেশি নফল ইবাদত, সালাত, সদকা, কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে রুহকে তাজা করতে হয়। আর এভাবে এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে মুমিন বান্দা মুত্তাকির স্তরে উঠে যায়। কিন্তু ইফতার সাহরিতে ভূরিভোজ করে, যৌনাচারে সংযম না করে দিনের বড় সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে শরিয়তের দৃষ্টিতে বাহ্যিক সিয়াম আদায় হয়ে যাবে ঠিক কিন্তু সে সিয়ামের মাধ্যমে না নফস দুর্বল হবে, না রুহানি শক্তি বাড়বে। অর্থাৎ না খেয়ে থাকা ছাড়া ব্যক্তিটির আর কোনো উপকারই হলো না।

হাদিস শরিফে ঠিক এ কথাটিই বলেছেন রসুল (সা.)। ইমাম ইবনে হিব্বান এবং ইমাম হাকেম (রহ.) নিজেদের গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) বলেন, ‘লাইসাস সিয়ামু মিন আকলি ওয়াশশুরবি, ইন্নামাস সিয়ামু মিনাললাগবি ওয়াররাফাস। অর্থাৎ পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা।’ বুখারির বর্ণনায় আরও কঠিন কথা এসেছে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে পাপাচার, মিথ্যাচার ও মূর্খতাসুলভ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেনি, তার না খেয়ে থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ এ হাদিস দুটি খুব স্পষ্ট করেই বলছে, তাকওয়ার সাধনা না করলে লোক দেখানো না খেয়ে থাকায় আসলে পরকালীন ও আধ্যাত্মিক কোনো ফায়দা নেই। তাই আসুন আমরা প্রতিটি সিয়ামকে তাকওয়ার সিঁড়ি হিসেবে গ্রহণ করি। শুধু খাবার খেলেই আল্লাহ দেখবেন এমনটি নয় বরং সর্বক্ষণ আমি মহান আল্লাহর সিসি ক্যামেরার আওতায় আছি, এ বোধ নিজের ভিতর জাগিয়ে তুলি। তবেই আমাদের সিয়াম হবে কোরআনের সিয়াম। আমরা হব সিয়াম সাধক।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর,www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর