বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপিকে ভোটে আনতে আমেরিকার সহায়তা চাইল বাংলাদেশ

ওয়াশিংটনে ড. মোমেন-ব্লিনকেন বৈঠক র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা আপাতত উঠছে না

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

বিএনপিকে ভোটে আনতে আমেরিকার সহায়তা চাইল বাংলাদেশ

ওয়াশিংটন ডিসিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর, রাশেদ চৌধুরীকে হস্তান্তরসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বৈঠকে আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হয় এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা জানান দেন ব্লিনকেন। জবাবে মোমেন বলেন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা। যোগ করেন, সব দল নির্বাচনে আসতে চায় শুধু একটি দল (বিএনপি) ছাড়া। তিনি বলেন, তারা স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়, কোথাও কোথাও বিজয়ীও হয়। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ব্লিনকেনের সহযোগিতা চান মোমেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে বৈঠকের বিষয়ে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। এ সময় সামনের বছরের নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, আমাদের অপেক্ষাকৃত নতুন গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র আড়াই শ বছর ধরে এর চর্চা করছে, এখানে এখনো সমস্যা হয়। বাংলাদেশে ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ বছর সামরিক সরকারের অধীনে ছিল। বাংলাদেশে একটি দল নির্বাচনে আসে না। তাদের নির্বাচনে আনাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করেন ড. মোমেন। তিনি বলেন, একটি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা সরকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর হাতে গঠিত একটি দল জাতীয় নির্বাচনে আসতে চায় না। তারা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং অনেক জায়গায় জয়ীও হয়েছে। অথচ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তারা গোঁ ধরে আছে। এ অবস্থায় আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান রেখেছি ওই দলটিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে আন্তরিক সহায়তা করতে। কারণ আমরা নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই সংস্কার সাধন করেছি। নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধপরিকর। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার প্রসঙ্গও উঠে আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করে বলেছেন, এ সহায়তার ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে। বাংলাদেশ উদারভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে এ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পেতে চায়।

আলোচনায় র‌্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ এসেছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি উঠেছে এবং আমরা বলেছি র‌্যাব গঠনের উদ্দেশ্যই ছিল সন্ত্রাস দমন। বাংলাদেশজুড়ে আন্দোলনের নামে বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময় সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশেও গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এসব দমনে র‌্যাব বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে। র‌্যাব কোথাও কোথাও বেশি করেছে এমনটি উল্লেখ করেই আমি বলেছি বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেষ্ট রয়েছি, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টিতে আমি অনেক বেশি আশাবাদী। তবে এটি একটি প্রক্রিয়ার বিষয়। সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। র‌্যাব নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করা সাবেক রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির মন্তব্য উদ্ধৃত করে ড. মোমেন এ বৈঠকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই যেমন অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস সহিংসতা দূর করতে কাজ করে বাংলাদেশে র‌্যাবও একই ভূমিকা পালন করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসলে র?্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সুইচ অন-অফের মতো নয়। তিনি বলেন, এটি তারা (যুক্তরাষ্ট্র) চাইলেও হঠাৎ করে প্রত্যাহার করতে পারবে না। এর একটি প্রসেস রয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আরও বলেছেন বলেও জানান ড. এ কে আবদুল মোমেন। অ্যান্টনি ব্লিনকেনকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারে এমনটা উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও আমরা মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। এর আগে স্টেট ডিপার্টমেন্টের থমাস জেফারসন রুমে বৈঠকের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছি। আমাদের ৫০ বছরের এ পথচলার কথা ভাবলে আমরা আমাদের অংশীদারি শক্তিশালী করতে আগামী ৫০ বছর একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশা করি। ব্লিনকেন বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অন্য দেশগুলোকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা তাদের এ কাজের প্রশংসা করি এবং আমরা কভিড-১৯ মোকাবিলায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। এবং কোভ্যাক্সের মাধ্যমে প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ কভিড-১৯ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দিতে পেরে আমরা গর্বিত। মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকারে হয়ে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসাধারণ মানবতা ও উদারতা দেখাচ্ছে। আমরা সে কারণে এবং বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার অন্যতম প্রবল সমর্থক ও এমন আরও অনেক কাজের জন্য (বাংলাদেশের কাছে) কৃতজ্ঞ। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ৬ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার জন্য, যা সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমি মনে করি টিকার ডোজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি পাওয়া ৩১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২৭০ কোটি টাকা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এবং আমি আপনাকে আরও ধন্যবাদ জানাই কারণ আপনি মিয়ানমারে গণহত্যা হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন এবং আমরা খুব খুশি যে আপনি এটা করেছেন। আমি আশা করি নির্যাতিত এই মানুষেরা স্বদেশে প্রত্যাবাসিত হবেন। মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বন্ধু হয়ে আমাদের পাশে ছিল, আমাদের দুঃসময়ে ও আমাদের সুসময়ে। এবং আমরা একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা রাখি এবং সে কারণেই আজকে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। বছরের পর বছর ধরে আপনারা আমাদের সমর্থন দিচ্ছেন, সহায়তা করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ পথচলা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশে আপনাদের অর্জন আরও বৃদ্ধি পাবে কারণ আমাদের পথচলায় যুক্তরাষ্ট্র সব সময় সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার এবং বাংলাদেশে পুঞ্জীভূত বিনিয়োগ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগ জ্বালানি খাতে করা হয়েছে। হয়তো এখন জ্বালানি খাতের বাইরে তাকানোর সময় হয়েছে। এবং আমি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও উন্নত ও দৃঢ় এবং সুদৃঢ় সম্পর্কের প্রত্যাশা করছি। সব শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, আমি সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি কারণ আমি যখন গৃহহীন, বেকার ও রাষ্ট্রহীন ছিলাম তখন যুক্তরাষ্ট্র আমাকে একটি বাড়ি ও চাকরি দিয়েছিল এবং এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

সর্বশেষ খবর